১৩ সেপ্টেম্বর আয়োজিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬১তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে 'জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণা' গৃহীত হয়েছে। ঘোষণার পক্ষে ১৪৩টি ভোট এবং বিপক্ষে ৪টি ভোট পড়ে। এ ছাড়া ১১টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। যদিও কয়েকটি দেশ ঘোষণার বিষয়বস্তু ভিন্নমত প্রকাশ করেছে, তবুও ঘোষণা গ্রহণ করা নিঃসন্দেহ আন্তর্জাতিক সম্প্রাদয়ের আদিবাসীদের স্বার্থ বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিপুলভাবে একমত হওয়ার প্রতীক এবং মানবজাতির ন্যায্য অধিকার ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে এর নবযুগের সূচনার তাত্পর্য রয়েছে।
ঘোষণায় বলা হয়েছে যে, 'জাতিসংঘ সনদ' ও 'বিশ্ব মানবিক ঘোষণা'র ভিত্তিতে আদিবাসীদের সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগত জমি, সম্পদ, সংস্কার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থানসহ কতগুলো মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছে। ঘোষণায় জোর দেয়া হয়েছে যে, আদিবাসীরা তাদের নিজেদের রীতিগত পদ্ধতির মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক তত্পরতায় লিপ্ত থাকার বিষয়টিকে সম্মান করা, যে কোনো ধরনের বৈষম্যের বিরোধিতা করা এবং বিভিন্ন দেশের সরকার সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের উপযোগী আইন তৈরী করে আদিবাসীদের সঙ্গে সুষম সহাবস্থান নিশ্চিত করা।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষেদর চেয়ারম্যান শেখা হায়া রাশেদ আল খালিফা এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের বিশেষ কর্মাকর্তা লুইস আর্বার এদিন এ ঘোষণাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বান কি মুন বলেছেন, ঘোষণার গ্রহণ হচ্ছে বিশ্বের আদিবাসীদের বিজয়। আদিবাসীরা এবং তাদের দেশগুলোর সরকার এখন থেকে মানবিক, ন্যায্য এবং অভিন্ন উন্নয়নের পথে সবার সঙ্গে তাদের ভবিষ্যত্ সৃষ্টি করবে। তিনি বিভিন্ন সরকার ও বেসরকারী সংস্থাগুলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণের কাজ মানবিক ব্রত হিসেবে সমাজের সুষম উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় একীভূত করার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ঘোষণার মর্ম অনুসরণ সম্ভব হয়।
বর্তমানে আদিবাসী সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোন সাধারণ সংজ্ঞা নেই। সাধারণত আদিবাসী মানে বহিঃ জাতির সবতি শুরু করার আগে, বংশপরম্পরায় একটি দেশ অথবা অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্নভাবে থাকা মানুষরা। বাইরের মানুষের অনুপ্রবেশ এবং ভিন্ন সংস্কৃতির 'আত্মীকরণের মধ্য দিয়ে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন হওয়ার পথে। যেমন আমেরিকার রেড ইণ্ডিয়ান, ওশেনিয়ার মাওরি এবং উত্তর মেরুবৃত্ত সংলগ্ন ইরিউটসহ বিভিন্ন জাতির মানুষ। জাতিসংঘের অনুমান অনুযায়ী, বিশ্বের ৫টি মহাদেশের ৭০টি দেশে প্রায় ৫ হাজারের বেশী আদিবাসী রয়েছে। এ সংখ্যা মোট ৩৭ কোটির মত। দীর্ঘকাল ধরে বৈষম্যের কারণে অনেক আদিবাসীদের জীবন দ্রারিদ্র্যতায় ভরা, তাকিছু কিছু আদিবাসী জাতির সংস্কৃতি ও এখন বলতে গেলে বিলুপ্তির পথে। মানবজাতির সভ্যতার অগ্রগতি এবং সমাজের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি নিয়মবিধি তৈরী করে আদিবাসী এবং তাদের সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। তবে, ঘোষণা গ্রহণ করতে ২০ বছরেরও বেশী সময় লেগেছে।
'জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণা'-এর খসড়া তৈরীর কাজ ১৯৮৫ সালে শুরু হয়। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব মানবজাতি সম্মেলন 'বিশ্ব আদিবাসী আন্তর্জাতিক বর্ষ' অধিবেশনের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আদিবাসীদের জীবন যাত্রার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ ছাড়াও তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সম্মান করা এবং তাদের সুষম অধিকার এবং অস্তিত্বের নিশ্চয়তা সংরক্ষণ করার আহ্বান জানিয়েছে। এর পাশাপাশি, পরিষদ 'বিশ্ব আদিবাসীদের আন্তর্জাতিক বর্ষ-- ১৯৯৫—২০০৪' এবং প্রতি বছরের ৮ আগস্টকে 'বিশ্ব আদিবাসী দিবস' ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাতে অধিকতরভাবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে জোরদার এবং কার্যকরভাবে পরিবেশ সংরক্ষণ, অর্থনীতির উন্নয়ন, শিক্ষা ও চিকিত্সাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের আদিবাসীদের সম্মুখীন সমস্যাগুলোর সমাধান করা যায়। ২০ বছরের বেশী সময় ধরে পুংখানুপুঙ্খ আলোচনার মাধ্যমে এ ঘোষণা গত বছরের জুন মাসে মানববিক পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রথম অধিবেশনে গৃহীত হয়।
ঘোষণার মধ্যে কিছু বিষয়বস্তুর প্রতি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডাসহ বিভিন্ন আদিবাসী অধুষিত দেশগুলো নিজেদের স্বার্থের কারণে ঘোষণার বিরোধিতা করেছে, বিশেষ করে নিজেদের সিদ্ধান্ত, ভুমির, অধিকার, মেধা-স্বত্ব এবং বিভিন্ন কারণে সরকারের নীতি নির্ধারকদের নামন্জুর করার অধিকারসহ বিভিন্ন সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে। এ সব দেশ জোর দিয়ে বলেছে যে, এ ঘোষণা তাদের দেশের বর্তমান আইনের সঙ্গে সুসংবন্ধ করে এবং নিজেদের দেশের আইনের মধ্য দিয়ে সমাধান করে সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে নিয়ে আসা আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণের প্রতিকূল। এমনকি সমস্যাটিকে এর ফলে আরো জটিল করে দেয়া হবে। তবে এ সব দেশ অব্যাহতভাবে আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ ব্রত ত্বরান্বতি করার কথা প্রকাশ করেছে।
(খোংচিয়াচিয়া)
|