চিন লি বৃটেন থেকে আসা একজন চীনা মেয়ে । ৪ বছর আগে তাঁর আর্থিক সাহায্যে দক্ষিণ চীনের দুটি বাঘ আফ্রিকার বনে ভ্রমণ করেছে বলে যে খবর প্রচার করা হয়েছে সে সম্পর্কে এবং কেন তিনি দুটি কচি বাঘ নিয়ে নির্জন তৃণভূমিতে যান সে সম্পর্কে চিন লি বলেছেন, আমি প্রাকৃতিক পরিবেশ ভালবাসি আমি পশু পছন্দ করি ।
চিন লি অনেক বছর আগে পেইচিং ইউনিভার্সিটির বৃটেন-আমেরিকা সাহিত্য বিভাগ থেকে স্নাতক হন । তার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এক বিখ্যাত বাণিজ্য ইনস্টিটিউটে এমবিএ পড়েন । তার পর তিনি আন্তর্জাতিক বিখ্যাত মার্কা ইতালির গুস্সি ফ্যাশন কোম্পানিতে কাজ নেন । তিনি এ কোম্পানিতে ৭ বছর ধরে বিখ্যাত মার্কার অথেন্টিকেটার ছিলেন । ইতালীভাষী দেশে ইতালীয় ব্যক্তির পক্ষেও এমন একটি পদ পাওয়া সহজ নয় । তখন তাঁর বার্ষিক বেতন ২ লাখ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে । এর পর প্রেমের জন্য তিনি চাকরী ছেড়ে লন্ডনে গিয়ে গৃহিনী হন ।
চিন লির স্বামী তহবিল ও বাণিজ্যিক কাজ করে মোটা আয় করেন । লন্ডনে তারা খুব বড় ও সুন্দর একটি বাগান বাড়িতে থাকেন । প্রতি বছর স্বামী-স্ত্রী দুজন ব্যক্তিগত বিমানযোগে বিশ্ব ভ্রমণ করতে যান । কিন্তু তিন বছর গৃহিনী হওয়ার পর চিন লি মনে নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন । তিনি বিশ্বের পক্ষে তাত্পর্যসম্পন্ন হয় এমন একটি কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন ।
২০০৩ সালের আগষ্ট মাসে চীনের বন ব্যুরোর সমর্থনে দুটো বাঘের বাচ্চাতাদের আফ্রিকা যাত্রা শুরু করল । চিন লি আফ্রিকায় বাঘ দুটোর জন্য যে বাড়ি বানিয়েছেন তা ১৭টি ফার্ম নিয়ে গঠিত । এর মোট আয়তন ছিল ৩০ হাজার হেক্টর । এই জমি কিনতে চিন লি তার সব ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের অর্থ ব্যয় করেছেন । তিনি বলেন , আফ্রিকার বনে প্রশিক্ষণ নিলেই এই লুপ্তপ্রায় প্রাণীকে সংরক্ষণকরা যায় । যাতে বাঘ বাইরে এসে মানুষের ক্ষতি সাধন না করে তার জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের চার পাশে বৈদ্যুদিক তারের জাল বসিয়ে দেয়া হয়েছে ।
বাঘ দুটোর জন্য একটি আদিম প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরীর জন্য বন্য নীলগাই, জেব্রা, বন্য গরু সহ নানা বন্য পশু কেনা হয়েছে । বাঘের বাচ্চা দুটো এখানে প্রাথমিক বন্য প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করল ।
আফ্রিকায় পাঠানো দুটো বাঘের মধ্যে পুরুষ বাঘটির নাম হল "কো থাই" আর বাঘিনীর নাম হল "আশা" । চিন লি বলেন , এখানে শুধু "কো থাই" ও "সিওয়াং অর্থাতআশা" এই দুটো বাঘ বন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তা নয় তার নিজের চিন্তাধারারও বিরাট পরিবর্তন হয়েছে । কষ্টের সময় আগের আরামের জীবনযাত্রা তার প্রায়ইমনে পড়ে । কিন্তু বাঘের বাচ্চা দুটোধীরেধীরে বুন পরিবেশে মিশে যাচ্ছেদেখে চিন লি নিজেকে সৌভাগ্যবানবলে মনে করতেন ।তিনি মনে করতেন যে ,যদি সবাই তার মতো সুযোগ পেয়ে এই সব আদরের প্রাণীর সঙ্গে মেলামেশা করতে পারতেন তাহলে সবাই তাদেরকে শত্রু হিসেবে ব্যবহার করতেন না অথবা তাদের ক্ষতি সাধন করতেন না ।
ছোটো বেলা থেকেই চিন লি বিড়ালকে খুব পছন্দ করতেন । অ-পরিস্কার ভয়ে বাবা মা বিড়ালকে অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছেন । কান্নাকাটি করেও চিন লি বিড়ালকে রক্ষা করতে পারেন নি । কিন্তু জেদ চিন লি নিজের পদ্ধতি নিয়ে প্রতিবাদ জানাতেন যে, বাবা মা একটি বিড়াল বিতাড়িত করে, কিছু দিন পর চিন লি আর এক নতুন বিড়াল নিয়ে আসে । একটার পর একটা বিড়াল চিন লির পাশে থাকত । বলা যায় বিড়াল নিয়েই চিন লি নিজের শিশু কাল কাটিয়ে ফেললেন । চিন লি বলেন , বন্য প্রাণী সুরক্ষা এলাকা থাকলে , অথবা আফ্রিকায় থাকার মতো নিজের মাতৃভূমির বিশেষ প্রাণী দেখতে পারলে চীনারা প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে নিজেদের ধারণা পরিবর্তন করতে পারবেন এবং বন্য প্রাণী রক্ষার জন্য আরও বেশি কাজ করতে পারবেন ।
অতীতের দক্ষিণ আফ্রিকায় বাঘগুলোকে বন্য করার প্রক্রিয়ার সময় ছিল একটি অত্যন্ত দুঃখ ও দুর্ভাগ্যেরসময় । কিছু দিন আগে " আশা" নামক বাঘের মৃত্যু ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক ।
চিন লির খুবই দুঃখ ও ব্যথা লাগে । তিনি বলেন , অনেকের পক্ষে "আশা" শুধু এক অতি সাধারণ বাঘ নয় । সে সবচেয়ে সাহসী বা সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান বাঘ নয় । তবে সে একটি সবচেয়ে আদরের বাঘ ছিল । সে সব সময় মানুষের গুরুত্ব পেতে চায় । সে ঘাড়ে ঘেষাঘেষি করে এবং "ফ ফ" শব্দ করে মানুষের আদর পাওয়ার একটি বাঘ । সে গান গাইতে পছন্দ করত । ক্ষিদের সময় সে নিচু স্বরে নিজের প্রতিবাদ জানাত । চিন লির চোখে " আশা" নিজের বাচ্চা । "আশা"র মৃত্যুতে তার যে দুঃখ যে বেদনা হয়েছে যেন নিজের ছেলের মৃত্যু হয়েছে ।
" আশা"র মৃত্যু হওয়ার খবর আফ্রিকা ছড়িয়ে দেশে আসার পর বাঘের বাচ্চারবিদেশ ভ্রমণ সম্পর্কে দেশের ভেতরে নানা মতামত সৃষ্টি হয় । এ সম্পর্কে চিন লি বলেন , আমার অনুচিত হয়নি । এর আগে আমি আমার সমালোচনা অনেক শুনেছি । কিন্তু যে যাই বলুক না কেন তা আমাকে রোধ করতে পারবে না । কেবল বাস্তব কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজের নির্ভুল দিক প্রমাণ করব । আসলে প্রমাণ করার কিছু দরকার নেই । আমি যা করছি তা আমার হৃদয়,, আমার শখ এবং আমার আন্তরিকতা নিয়ে করেছি । সফল হোক , ব্যর্থ হোকআমি চেষ্টা করেছি , তাই আমি অনুতপ্ত নই।
এখন চিন লি এক বছরের বেশি সময় নিয়ে এশিয়া , আফ্রিকা এবং ইউরোপের মধ্যে যাতায়াত করছেন । সময় পার্থক্যের কারণে চিন লির ঘুম ভাল হয়নি । তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন , ২০০৮ সালে আফ্রিকায় প্রশিক্ষণরত বাঘদুটোকে চীনে ফিরিয়ে আনবেন । এখন বাঘদুটো বড় হয়েছে । কিন্তু এখন দেশের ভেতরে তাদের পোষার উপযোগী জায়গা নেই ।
২০০৭ সালের ২৩ এপ্রিল সুচৌ চিড়িয়াখানার এক বাঘ তার আফ্রিকা যাত্রা শুরু করে । সে "আশা" ও "কোথাই"র পক্ষ থেকে বাচ্চা জন্ম দেয়ার দায়িত্ব পালন করবে । চিন লি বলেন , বাঘকে খাঁচায় বন্দী করা চিরকালই তার আত্মাকে জয় করতে পারবে না । মানবজাতির হৃদয় যতই বড়, প্রাণীর অস্তিত্ব থাকার অবকাশ ততই বড় হবে এবং অবশেষে মানবজাতি ততই লাভবান হবে ।
|