শে জাতি দক্ষিণ চীনের একটি সংখ্যালঘু জাতি । এর ৯০ শতাংশেরও বেশি অধিবাসী চীনের উপকূলীয় ফুচিয়ান প্রদেশের পূর্বাংশ ও চেচিয়াং প্রদেশের দক্ষিণাংশে বসবাস করছে । শে জাতির পূর্বপুরুষরা যাযাবরের মত স্থানান্তর করতে পছন্দ করতো । প্রাচীনকালে তারা দক্ষিণ চীনের অধিকাংশ অঞ্চলে থাকতো । নিরন্তর স্থানান্তর করার পাশাপাশি শে জাতির লোক সংগীতও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে । এখন শে জাতির জন্মভূমিকে গানের সাগর বলা হয় ।
পাইলুখাং পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি উপকূলীয় ছোট গ্রাম । এই গ্রাম চেচিয়াং প্রদেশের পূর্বাংশে শে জাতির একটি প্রধান অধ্যুষিত এলাকা । এই অঞ্চলের লোকেরা সবসময় গান গাইতে পছন্দ করেন । গান গাওয়া শে জাতির নিত্য দিনের একটি অত্যাবশ্যক অংশে পরিণত হয়েছে ।
পাইলুখাং গ্রামে সংবাদদাতা ৭৫ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ চুং ছাং রাও'র সঙ্গে দেখা করলেন । বৃদ্ধ চুং ছোট বেলা থেকেই প্রবীণদের কাছ থেকে শে জাতির গান গাইতে শুরু করেন । তিনি বলেন , যেখানে শে জাতির অধিবাসীরা থাকে , সেখানে শে জাতির লোক সংগীত শোনা যায় । বিশেষ করে শে জাতির বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী উত্সবে সাধারণতঃ একসঙ্গে কয়েক হাজার লোকের সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । যখন এই ধরণের সংগীতানুষ্ঠান আয়োজন করা হয় , তখন সংগীতাষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য চার দিকের গ্রামবাসীরা এ উত্সস্থানে জড়ো হয় । তারা সবাই গান গাইতে পারে । অল্প বয়সে বৃদ্ধ চুং ছাং রাও বহু বার এই ধরনের সংগীতানুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন । এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন ,
এক দিন গান গাওয়ার জন্য তিনি ও তার একজন আত্মীয় পাহাড়ের উপরে যান । সন্ধ্যায় খাওয়ার পর তারা গান গাইতে গেলেন । মধ্যরাতে গান গাওয়া শেষে তারা বাড়ি ফিরে যেতে শুরু করলেন । পথে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিলো । ফলে তারা দু'জনই আপাদমস্তক ভিজে গেলেন পড়লেন । কিন্তু তারা খুব খুশি ।
বৃদ্ধ চুং ছাং রাও বলেন , শে জাতির লিখিত ভাষা নেই । সুতরাং শে জাতির লেখালেখি হান ভাষায় লেখার ওপর নিভরশীল । আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি উত্পাদন ও জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে শে জাতি ও হান জাতির ব্যবধান ক্রমাগতভাবে কমে যাচ্ছে । শে জাতির বহু অল্পবয়সীরা শে জাতির ভাষাও বলতে পারছে না । ফলে শে জাতির সংস্কৃতি ও লোক সংগীত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে । এতে বৃদ্ধ চুং ছাং রাও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ।
আগে পাইলুখাং গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে হাতের লেখা কয়েকটি গানের বইপুস্তক ছিল । এখন এ সব বইপুস্তকও বিলুপ্তির দিকে চলছে । বেশ কিছু বয়স্ক মারা গেছেন । অধিকাংশ অল্পবয়সীরা শে ভাষাও বলতে পারে না । শে জাতির গান গাওয়া তো আরো দূরের কথা ।
গত কয়েক দশকে পাইলুখাং গ্রাম ও শে জাতির অন্যান্য থানায় লোক সংগীতানুষ্ঠান বন্ধ হয়েছিল । জাতির ঐতিহ্যবাহী লোক সংগীতের বইপুস্তকও পাওয়া যেতো না । এতে চুং ছাং রাও খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন । পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হওয়ার জন্য তিনি খুব মর্মাহত হন । তখন তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে একটি সিদ্ধান্ত নিলেন যে , তিনি নিজের খরচে শে জাতির লোক সংগীত সংগ্রহের চেষ্টা করবেন । তিনি সংবাদদাতাকে বলেন ,
গত ৫ বছর ধরে তিনি শে জাতির লোক সংগীত সংগ্রহের জন্য ৫টি জেলার ৭১টি গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছেন । গানগুলি লিখে নেয়ার জন্য তার কয়েক শো কলম ব্যবহার করতে হয়েছে এবং গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর জন্য তার অন্তত৫ জোড়া জুতা নষ্ট হয়েছে । অনুমান করা হচ্ছে , শে জাতির যাবতীয় সংগীত সংগ্রহের জন্য ৮ লাখেরও বেশি শব্দের প্রয়োজন ।
এক দিন চুং ছাং রাও শুনেছেন , পাইলুখাং গ্রামের অনেক দূরে অবস্থিত ইয়াংপিয়ান গ্রামে শে জাতির এক জনের সংগ্রহে বাড়িতে বহু সংগীত পুস্তক রয়েছে । কথাটা শুনে তিনি তাড়াতাড়ি এই গ্রামে যান । তিনি গৃহকর্তার কাছে সংগৃহিত সংগীত পুস্তকগুলো চান । কিন্তু গৃহকর্তা তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন । তার সততা ও আন্তরিকতার জন্য গৃহকর্তা অবশেষে রাজী হন । গৃহকর্তা তাকে তার বাড়িতে সংগীত পুস্তক থেকে হাতে লিখে নিতে দিয়েছেন ।
ঐ দিন রাত চু ছাং রাও ঘুমান নি । তিনি একটানা ৩ শো'রও বেশি সংগীত হাতে লিখে নিয়েছেন । এতে গৃহকর্তা মুগ্ধ হন । পরের দিন হাতে লিখে নেয়ার জন্য চল্লিশ-পঞ্চাশটি সংগীত পুস্তক বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি চুং ছাং রাওকে অনুমতি দেন । ঐ গ্রাম থেকে চুং ছাং রাও মোট এক হাজারেরও বেশি সংগীত সংগ্রহ করেছেন । পরে অধিক থেকে অধিকতর গ্রামবাসী তার সংগীত সংগ্রহের কথা জেনে যান । অনেকে তার কাছে সংগীত পুস্তক পাঠান । সংগীত সংগ্রহের ক্ষেত্রে তার স্ত্রী লেই ওয়েন ইয়্যু তাকে ব্যাপক সহায়তা করেছেন ।
বৃদ্ধ চুং ছাং রাও পাঁচ ছয় বছর ধরে সংগীত সংগ্রহ করেছেন । তিনি নিজের স্বামীর এই কাজে খুব সাহায্য করেন । তিনি নিজেও গান গাইতে পছন্দ করেন । যখন বৃদ্ধ চুং সংগীত সংগ্রহ করে বাড়িতে ফিরে আসতেন , তখন তিনি তাকে খুব সাহায্য করেন । শে জাতির সংস্কৃতি সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি স্বামীর কাজে যথেষ্ট সাহায্য করেন ।
তার পরবর্তী কয়েক বছরে চুং ছাং রাও প্রেমের গান ও কাহিনীভিত্তিক সংগীতসহ শে জাতির রকমারি সংগীত সংগ্রহ করেছেন । শে জাতির সংগীতের প্রতি তার অশেষ আনুগত্য ও স্নেহের জন্য চুং ছাং রাও গ্রামবাসীদের ভালবাসা ও শ্রদ্ধাকে জয় করেছেন । সবাই তাকে সংগীতের রাজা বলে ডাকেন । গ্রামবাসী লেই আ লুং সংবাদদাতাকে বলেন,
পাইলুখাং গ্রামে যে সব অল্পবয়সী লোক শে জাতির গান গাইতে পারে না ও এ জাতির ভাষা বলতে পারে না, তাদের এ সব জ্ঞান শেখানো হয়েছে । তারা এখন শে জাতির সংস্কৃতি ও বৈশিষ্ট্য বুঝতে পেরেছে । শে জাতির মৌখিক ভাষা আছে , কিন্তু লিখিত ভাষা নেই । সুতরাং শে জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণের জন্য শে জাতির লোক সংগীতের ওপর নির্ভর করতে হবে ।
এখন স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে শে জাতির সংস্কৃতি বাঁচানো বিষয়ক কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । স্থানীয় সরকার ও জনসাধারণ শে জাতির লোক সংগীতের সংগ্রহ ও সংরক্ষার ওপর খিব গুরুত্ব দিচ্ছে ।
|