প্রথমেই "সেই সুদূর জায়গায়" নামে একটি গান দিয়ে শুরু করছি। গানের কথাগুলো এমনঃ "সেই সুদূর জায়গায় একজন ভালো মেয়ে আছে। কেউ তাঁর ঘরের বাইরে চলার সময় ভিতরে দেখতে খুব ইচ্ছা করে। তাঁর সুন্দর হাঁসি মুখ লাল সুর্যের মতো। তাঁর প্রাণবন্ত চোখ রাতের মনোরম চাঁদের মতো। আমি সব সম্পত্তি পরিত্যাগ করে তাঁর সঙ্গে ভেড়া পালন করতে চাই। প্রতিদিন তাঁকে হাসি মুখ আর সোনালী পোষাকে দেখতে চাই। আমি একটি ছোট ভেড়া হয়ে তাঁর পাশে থাকতে চাই।"
ছিংহাই প্রদেশের এই লোকসংগীত চীনের বিখ্যাত সুরকার ওয়াং লো বিনের সংগ্রহ ও পরিশিলীত করার পর চীনে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। যেখানেই চীনা লোক, সেখানেই এই গানটি শুনা যায়। ফলে তাকে "বিংশ শতাব্দীর চীনের সর্বোত্কৃষ্ট সংগীত" হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
সুললিত "সেই সুদুর জায়গায়" নামক গানের সুরে সুরে আমাদের পশ্চিম চীনের ছিংহাই প্রদেশে নিয়ে যায়। ছিংহাই চীনের তিনটি বৃহত্ নদী---ছাংচিয়াং নদী, হুয়াংহো নদী ও লানচাং নদীর উত্স স্থল। ছিংহাইয়ের অধিকাংশ জায়গা "পৃথিবীর ছাদ" ---ছিংহাই-তিব্বত মালভূমির আওতায়। ছিংহাই প্রদেশে উচু পাহাড়, গিরিখাত, অববাহিকা ও মালভূমিসহ জটিল ও বৈচিত্র্যময় ভৌগলিক আকার রয়েছে।
ছিংহাইয়ে হান , তিব্বতী, হুই, সালা ও তু জাতিসহ দশ বারোটি জাতি বসবাস করে। এই সংখ্যালঘুজাতিগুলোর অধিকাংশই নাচ-গানে পারদর্শী। সেখানে অসংখ্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও অনেক সুললিত লোকসংগীত প্রচলিত আছে। এখন শুনুন ছিংহাইয়ের লোকসংগীত "কিশোর তরুণের চেয়ে ভালো"। এ গানটি হচ্ছে ছিংহাই প্রদেশের প্রচলিত এক ধরনের লোকসংগীত। এর স্থানীয় নাম "হুয়ার"। গানের সুর আনন্দময় ও উষ্ণময়। গানে তরুণ ব্যক্তি তার প্রিয় মেয়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা, নিজের ওপর আস্থা ও ভবিষ্যত জীবনের ওপর তীব্র প্রত্যাশার কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
গানের কথাগুলো এমনঃ "পাহাড়গুলোর মধ্যে থাইজি পাহাড় সবচেয়ে ভাল। নদীগুলোর মধ্যে ছিন নদী সবচেয়ে ভালো। ফুলগুলোর মধ্যে লাল পিয়নী সবচেয়ে সুন্দর। কিশোর তরুণদের চেয়েও ভালো।"
"হুয়ার" হচ্ছে চীনের লোকসংগীতের মধ্যে এক রকম পাহাড়ী গান। উত্তর-পশ্চিম চীনের ছিংহাই, কানসুন, নিংসিয়া এই তিনটি প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ও সিনচিয়াং এর কিছু অঞ্চল জুড়ে এটি ছড়িয়ে আছে। এ কয়েক জায়গায় বহু জাতি একসাথে বসবাস করে বলে বর্তমানে "হুয়ার" হুই, হান, তু , সালা , তুংসিয়াং, বাওআন , তিব্বতী ও ইয়ুগুসহ বিভিন্ন জাতির অভিন্ন জনপ্রিয় গানে পরিণত হয়েছে। "হুয়ার" এর বিষয়বস্তু ব্যাপক এবং ধরণে রয়েছে রকমারিতা। শিল্পী নিজের ইচ্ছা মতো অনুষ্ঠান স্থলেই গানের কথা রচনা করে গান গাইতে পারেন। এ কয়েকটি প্রদেশে বসবাসকারী জনসাধারণ হয়তো লেখাপড়া জানেন না, কিন্তু সবাই "হুয়ার" এর গানের কথা সুন্দরভাবে রচনা করতে পারেন এবং গান গাইতে পারেন।
এখন শুনুন ছিংহাই প্রদেশের "হুয়াং"। এর নাম "ছোট মেয়ের পাহাড়ী ফুল ফুটেছে"। গানের কথা রহস্যময়। একজন তরুণের প্রেমিকাকে দেখার আগে তার মনের অনুভূতি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
দীর্ঘকাল ধরে মালভূমিতে ও পাহাড়ে "হুয়ার" এর প্রচলনের দরুণ এই সংগীতের সুর উচু ও আপন বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন জাতির ভিন্ন রীতিনীতি ও ভৌগলিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানের কারণে "হুয়ার" এর স্পস্ট জাতীয় পার্থক্যও বজায় রয়েছে। এখন শুনুন ছিংহাই প্রদেশের আরেকটি গান। এর শিরোনাম "ছোট বোনকে নিয়ে যাও"। সুরের মধ্যে গভীর বেদনাদায়ক ভাব রয়েছে। সুরে সুরে একটি মেয়ে তাঁর প্রেমিকার সঙ্গে বিদায়ের সময় মনের দুঃখ প্রকাশিত হয়েছে।
ছিংহাইয়ের লোকসংগীত প্রধানত ছিংহাইয়ের পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে ছিনিয়ে আছে। সেখানে হুয়াংহো নদীর তীরে হাজার হাজার হেক্টর আবাদি জমি আছে, দৃশ্য অতি সুন্দর। বিভিন্ন জাতির পরিশ্রমী লোকজন এখন সহাবস্থানে থাকেন। তাঁরা উজ্জ্বল জীবন সৃষ্টি করার পাশাপাশি নানা লোকসংগীতও সৃষ্টি করেছেন।
এখন আপনারা ছিংহাইয়ের লোকসংগীত "চার ঋতুর গান" শুনছেন। এই গানটি বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরত্ ও শীত এই চারটি ঋতুতে কী কী ফুল ফুটে , এমন প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়। গানের সুরের মধ্যে "হুয়ার" ও নাচের বৈশিষ্ট্য ভরপুর। গত শতাব্দীর ৫০'র দশকে তা পরিশীলিত করার পর চীনে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছে।
অনুষ্ঠানের শেষে এসে শুনুন ছিংহাইয়ের লোকসংগীত "সূচিকর্মের গান"। গানে একটি মেয়ে সূচীকর্মের মাধ্যমে সুক্ষ্ম কাজ করার পাশাপাশি নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তাভাবনার দৃশ্যের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
গানের কথা এমনঃ "মাতৃভুমির দৃশ্য কত সুন্দর। আমি তাকে সুই দিয়ে আমার সূচী শিল্পে ফুটিয়ে তুলি। আমি এক জোড়া প্রজাপতি রঙিন সুতোয় কাপড়ে কাজ উদ্ভাসিত করে তুলি। যেন প্রজাপতি দুটো একসাথে উড়ে বেড়ায়। আমি এক জোড়া ম্যান্ডারিন ডাক সুচী কর্মের মধ্য দিয়ে মনোরমভাবে এঁকে নেই। ম্যান্ডারিন ডাক সবসময় পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল। তাই তারা একসাথেই থাকে। আমি গতকাল রাতের মিষ্টি স্বপ্নগুলো সুচীকর্মে গেথে ফেলি। সেই স্বপ্ন যে স্বপ্নে আমার প্রেমিকার সঙ্গে মিলিত হয়েছি। আমি আগামীকালের উজ্জ্বল জীবনের নিখুত দিকগুলো সুইয়ের ফোঁড়ে ফুটিয়ে তুলি। আমার প্রেমিকার কাছ থেকে আমি কখনো বিচ্ছিন্ন হবো না।" (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে)
|