বর্তমানে চীনের কৃষকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সংগে সংগে তাদের মানসিক চাহিদাও বেড়েই চলেছে ।
চীনের ইয়ুন নান প্রদেশের চান ই জেলার লৌ চিয়া শান গ্রামে প্রবেশ করলে আপনারা দেখতে পাবেন , প্রতিটি বাড়ির বাইরের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা রয়েছে গ্রামীণ জীবনভিত্তিক নানা ধরণের সুন্দর ছবি । কোনো কোনো চিত্রে আঁকা রয়েছে মনোরম প্রাকৃতিক নি:সর্গ । কোনো কোনো চিত্রে কৃষকদের চাষাবাদের ব্যস্ততম দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে । আবার কিছু ছবিতে কৃষকদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনের দৃশ্য আঁকা হয়েছে । একের পর এক দেয়াল-চিত্র এ গ্রামকে অত্যন্ত সুন্দর করে তুলেছে । এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য যে , একটি সাধারণ গ্রামে এমন মনোরম দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় । আমাদের সংবাদাতা গ্রামের একজন নারীকে প্রশ্ন করলেন , আপনি ভালো আছেন । আপনার বাড়ির দেয়ালেও এ রকম চিত্র আঁকা হয়েছে ? তিনি উত্তরে বললেন , হাঁ ,আমার বাড়ির দেয়ালেও ছবি আঁকা হয়েছে । কত সুন্দর ।
আমাদের সংবাদদাতা আবার প্রশ্ন করলেন , তাহলে আপনি জানেন কি , কে এসব দেয়াল-চিত্র এঁকেছেন ? গ্রামবাসী উত্তরে বললেন , ওহ, আমাদের গ্রামের সবাই জানেন , চাই চাও সিউ এঁকেছেন ।
তখন আমাদের সংবাদদাতা মনে মনে ভাবছিলেন , চাই চাও সিউ কী ধরণের লোক ? গ্রামের ভেতরে যেতে যেতে একজন মহিলার সংগে আমাদের দেখা হলো । তার হাতে ছিল ছবি আঁকার কলম ও অন্যান্য উপকরণ । পাশের একজন গ্রামবাসী আমাকে বললেন , তিনি হলেন আমাদের গ্রামের চিত্রকর চাই চাও সিউ ।
আমাদের সংবাদাতা চাই চাও সিউয়ের সংগে আলাপ করতে শুরু করেন । তার বয়স চল্লিশের কাছাকিছি । মধ্যম গড়ন । তার শরীরে রয়েছে দক্ষতার ছাপ । তিনি কেন দেয়াল-চিত্র আঁকতে শুরু করেছেন । এ প্রসংগে তিনি বলেন ,
ছোটবেলা থেকেই নানীর প্রভাবে আমি হস্তলিপি লিখতে ও ছবি আঁকতে পছন্দ করে আসছি । তখন থেকে হস্তলিপি ও চিত্র আঁকার সংগে আমি এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি ।
ছোটবেলায় চাই চাও সিউয়ের মনে একটি স্বপ্ন ছিল , বড় হয়ে তিনি একজন চারুকলা শিক্ষিকা হবেন । ১৯৮৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি একটি স্থানীয় স্কুলে চারুকলার শিক্ষিকা হন । পরে তিনি চীনা চিত্র বিভাগে পড়াশোনা করে বি এ পাশ করেন । সেসময় চীনের গ্রামাঞ্চলে শিক্ষিতের হার খুব কম ছিল । বিশেষ করে চাই চাও সিউয়ের মত মেয়েদের শিক্ষিতের হার আরো কম । ১৯৮৭ সালে গ্রাম কমিটি সচিবের কাজ করার জন্যে তাকে আমন্ত্রণ করে । তারপর তিনি এ পদে বিশ বছর ধরে কাজ করছেন ।
২০০৫ সালে চান ই জেলা সরকার নতুন গ্রামাঞ্চল নির্মাণের সময় বিভিন্ন গ্রামের রাস্তা নির্মাণ করে এবং প্রত্যেক গ্রামবাসীর বাড়ির বাইরের দেয়ালে চুনকাম করে । প্রতিটি বাড়ির সাদা সাদা দেয়াল দেখে চাই চাও সিউ মনে মনে ভাবলেন , হস্তলিপি , চিত্র ও কার্টুনসহ জনসাধারণের প্রিয় শিল্পকলা কি দেয়ালে আঁকা যায় ? তার এ ধারণা গ্রাম কমিটির সমর্থন লাভ করল । ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি দেয়াল-চিত্র আঁকার কাজ শুরু করেন । এক মাসের মধ্যে তিনি বেশ কয়েকজন কৃষকের বাড়ির বাইরের দেয়ালে ত্রিশটিরও বেশি ছবি এঁকেছেন । তিনি বলেন ,
আমি রোজ সকাল ৭টা থেকে ছবি আঁকতে শুরু করি । দুপুরে কোনোক্রমে গ্রামবাসীদের বাড়িতে খেয়েদেয়ে আবার ছবি আঁকি । সন্ধ্যা হয়ে এলে আমি বাড়িতে ফিরে যাই । এতে কিছু পরিশ্রম করতে হলেও আমার মনে হয় , আমার কাজের মূল্য আছে ।
গ্রামবাসীদের চোখে চাই চাও সিউ সারা দিন একটি পরিশ্রমী মৌমাছির মত এ দেয়াল থেকে সে দেয়ালে উড়ে বেড়ান । তার পেছনে রাখা হয় সৌন্দর্য । সবাই তার ভূয়সী প্রশংসা করেন । গ্রামবাসী মাদাম ওয়াং বলেন ,
চাও সিউ সত্যিই পরিশ্রম করতে পারেন । তার আঁকা ছবি কত চমত্কার ।
অল্প দিনের মধ্যেই গ্রামবাসীরা একের পর এক নিজেদের বাড়ির দেয়ালে ছবি আঁকার জন্যে চাই চাও সিউকে আমন্ত্রণ করেন । তখন থেকে তিনি সবসময় ব্যস্ত থাকেন । তিনি গ্রামবাসীদের বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে প্রাকৃতিক নিসর্গ , ফুল ও পাখি , কার্টুন এবং হস্তলিপি আঁকতে থাকেন । এ ছবিগুলোতে চীনের গ্রামের সভ্যতা ও নতুন রীতিনীতি এবং সমাজের শান্তি ও সম্প্রীতিও তুলে ধরা হয় ।
একজনের ক্ষমতা সীমিত । চাই চাও সিউয়ের সবচেয়ে ব্যস্ততার সময় গ্রামের প্রাথমিস স্কুলের শিক্ষক , অবসরপ্রাপ্ত কর্মী এবং চারুকলা শেখা তার নিজের ভাইও তার সংগে মিলে ছবি আঁকেন । সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কেবল চার মাসের মধ্যে প্রায় ৩০০টি দেয়াল-চিত্র আঁকা হয়েছে । গ্রামের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা সুন্দর ছবি গ্রামবাসীদের জ্ঞানার্জন , আইন শেখা , নীতি জেনে রাখা এবং সভ্যতা প্রচারের উত্তম পাঠ্য-পুস্তকে পরিণত হয়েছে । গ্রামবাসী চাও তা পাও বলেন ,
অতীতে আমরা শহরবাসীদের জীবনকে ঈর্ষা করতাম । এখন আমরা আর তা করি না । কেন না , সভ্য গ্রাম নির্মাণ এবং রংবেরংয়ের দেয়াল-চিত্রের পরিচালনায় এখন গ্রামবাসীদের চেতনা উন্নত হয়েছে এবং তাদের প্রকৃতিও উন্নত হয়েছে । নোংরা কথা বলা এবং গালিগালাজ দেয়ার লোকও এখন আর দেখা যায় না ।
বৃদ্ধা ছেন লি এ গ্রামে অনেকদিন ধরে বাস করেছিলেন । লৌ চি শান গ্রামের দেয়াল-চিত্র দেখার জন্যে তিনি বিশেষভাবে এখানে এসেছেন । তিনি বলেন ,
আমি ৪০ বছর ধরে এখানে আসি নি । শুনেছি , লৌ চি শান গ্রামে নতুন গ্রামাঞ্চল নির্মাণের কাজ ভালোভাবে চালানো হয়েছে । আমি ভাবতে পারি নি যে , এ গ্রামে এত বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে । কুটিরগুলো এখন সবই নীল ইটের বাড়িতে পরিণত হয়েছে । অতীতে কেবল কাগজে যেসব ছবি দেখতে পেতাম , এখন লৌ চিয়া শানের দেয়ালে দেয়ালে দেখতে পাচ্ছি । এটি আমাকে হতবাক করেছে । আমি অল্প শিক্ষিত হলেও এসব দেয়াল-চিত্রের মাধ্যমে আমি অনেক কিছু জানতে পেরেছি । এ দেয়াল-চিত্র সত্যিই চমত্কার ।
লৌ চিয়া শান গ্রামের পরিবর্তন দেখে আশেপাশের গ্রামের কৃষকরাও দেয়াল-চিত্র আঁকার জন্যে চাই চাও সিউকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ।
|