প্রিয় শ্রোতাবন্ধরা, আপনারা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শুনছেন। আমি খোং চিয়া চিয়া, এবং আমার সঙ্গে রয়েছেন আমার সহকর্মী আ.বা.ম. ছালাউদ্দিন, সুদুর পেইচিং থেকে আপনাদের জানাচ্ছি একরাশ ফুলেল শুভেচ্ছা। খ. বন্ধুরা, গত বার আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা আপনাদের চীনের ইয়ুননান প্রদেশের পাথরবন দর্শনীয় স্থানে নিয়ে গিয়েছিলাম, আজকের অনুষ্ঠানে আমরা আপনাদের পাথরবনের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করবো।
ইয়ুন নানের পাথরবন এলাকায় চীনের সংখ্যালঘু জাতির একটি জাতি—সানি লোক বাস করে। তারা পাথরবনের 'আ শি মা' সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যময় জাতীয় নৃত্য সৃষ্টি করেছেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা আপনাদের সানি মানুষের কাছে নিয়ে যাবো এবং পাথরবনে তাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যগুলো উপলব্ধি করবো।
পাথরবন দর্শনীয় স্থানে, একটি ঝলমলে হ্রদ রয়েছে। হ্রদের পাশে একটি পাথর চূড়া দাঁড়ানো এবং পাথর চূড়ার আকার ঠিক একজন সানি উপজাতির মেয়ের মত। প্রতি দিন অসংখ্য পর্যটক এখানে ভ্রমন করতে আসে। পথপ্রদর্শক বি ইয়ুন হুয়া আমাদের জানিয়েছেন, এটা হচ্ছে বিখ্যাত 'আ শি মা পাথর চূড়া'। 'আ শি মা' এখানকার মেয়েদের সাধারণ নাম। তিনি বলেছেন,
এখানকার সব মেয়েকে 'আ শি মা' বলে গণ্য করা হয়। আ শি মা হচ্ছে ই ভাষা এবং এর অর্থ হচ্ছে সুন্দরী মেয়ে। আমরা পুরুষকে 'আ হে গে' বলি। এর অর্থ হচ্ছে পরিশ্রমী ও সাহসী।
'আ শি মা' পাথর চূড়া সম্পর্কে, একটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছেঃ একটি গরীব পরিবারে একটি সুন্দর মেয়ে জন্ম গ্রহণ করে। বাবামা তাকে 'আ শি মা' এই নাম দিলেন। আ শি মা ভালোভাবে নাচ ও গান করতে পারে। সুতরাং অনেক ছেলেই তাকে খুব পছন্দ করে। আ শি মা ছেলে 'আ হে'-এর সঙ্গে প্রেম করে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, তিনি শুধু আ হে'কেই বিয়ে করবে। এক বছর মশাল উত্সবের সময়, আ শি মা ও আ হে বিবাহের চুক্তি স্বাক্ষর করলো। এছাড়া একজন ধনী লোকের ছেলেও আ শি মাকে বিয়ে করতে চায়। সুতরাং ধনী লোকটি আ হে দূরে কোথাও গেছে আ শি মাকে তার বাসায় নিয়ে তার ছেলের সঙ্গে বিয়ে বাধ্য করলো। কিন্তু আ শি মা প্রত্যাখ্যান করলো। আ হে এই খবর শুনলেন, আ শি মাকে উদ্ধার করার জন্য পরের দিনরাতে ফিরে আসলেন। ধনী লোকটা খুব রাগ করলো এবং বন্যার জলে তাকে ভাসিয়ে দিলো। বন্যা আ শি মাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। পরে মেয়ে ইং শা গে আ শি মা'কে উদ্ধার করলেন। তারপর আ শি মা পাথর চূড়ায় পরিবর্তিত হল।
ই জাতির সানি লোক বংশপরমপরায় পাথরবন এলাকায় জীবন-যাপন করে। কয়েক'শ বছর ধরে গ্রামবাসীরা পাথর দিয়ে বাড়ি ও রাস্তা নির্মাণ করে আসছে। দীর্ঘ সময় ধরে লোক-রীতি গবেষণা কাজে লিপ্ত থাকা মি. হুয়াং শিং আমাদের জানিয়েছেন, পাথরবনের পাথর সংস্কৃতি সুদীর্ঘকালের বলা যায়। তিনি বলেছেন,
কারণ দীর্ঘকাল ধরেই আমাদের পিতৃপুরুষরা প্রকৃতিগত ভূমিতে জীবন-যাপন করেছে, সুতরাং ৮ লাখ বছর আগে, তারা পাথর দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম শুরু করলেন। তারপর তারা পাথরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৃতি সৃষ্টি করলেন।
ইতিহাসের পরিবর্তনে, স্থানীয় লোক ও পাথরবন প্রকৃতিগত ভূমি এবং এই ধরনের প্রকৃতিগত ভূমি গঠিত পাথরের সঙ্গে সেখানকার মানুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। পাথরবনের স্তম্ভের ওপর অতীতের সানি লোকের পাথর ছবি ও উত্কীর্ণলিপি রয়েছে, যাতে সানি লোকের প্রাচীনকালের উত্সর্গ অনুষ্ঠান, নৃত্য শিকার ও যুদ্ধের অবস্থা প্রতিফলিত হয়েছে। বলা যায়, পাথরবনে স্থানীয় সানি লোকের জীবন-যাপনের বিভিন্ন দিক যেমন ধর্ম, কিংবদন্তী, কবিতা, নৃত্য, সূচিকর্ম, পোশাক আর অলঙ্কার, স্থাপত্য ও উত্সবসহ বিভিন্ন অবস্থা দেখা যায়।
সানি লোকের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি সৃষ্টি করার পাশাপাশি, বর্নময় লোক সংস্কৃতি শিল্পও সৃষ্টি করেছেন। সানি লোকের বিশেষ ভাষা ও লেখা, সমৃদ্ধ কবিতা ও কিংবদন্তী, বর্ণোজ্জ্বল জাতীয় পোশাক, উদ্দীপনাময় জাতীয় নৃত্য ও গীত, কুস্তি প্রতিযোগিতা, বিশেষ স্টাইলের বিয়ে ও শেষকৃত্যানুষ্ঠান প্রাচীন জাতির সাংস্কৃতিক স্টাইল ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
এ পর্যন্ত, কত শতাব্দী চলে গেছে, আ শি মা'র কিংবদন্তী সানি লোকেরা সাধারণ জীবন, বিয়ে অথবা শেষকৃত্যানুষ্ঠান হলো তাদের রীতির একটি অংশ, যা সানি লোকদের মধ্যে খুব জনপ্রিয়।
চীনের ই জাতির মশাল উত্সবকে 'প্রাচ্যের আনন্দমেলা' বলে গণ্য করা হয় এবং এটা হচ্চে পাথরবন অঞ্চলের একটি বৃহত্তম জাতীয় উত্সব। যদি আপনারা প্রতি বছর জুন মাসের শেষে অথবা জুলাই মাসের প্রথম দিকে পাথরবনে আসেন, তাহলে আপনারা পাথরবনের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার পাশাপাশি, ই জাতির ঐতিহ্যগত মশাল উত্সবের আন্তরিকতাকে অনুভবও করতে পারবেন।
পাথরবনের ভূমিতে, ই জাতির মানুষে কাজ করা, বলি দেয়া, গান গাওয়া ও নৃত্য ও গীত এবং জাতীয় মশাল উত্সব বিশ্ব বিখ্যাত 'প্রাচ্য আনন্দমেলা'-য় পরিণত হয়েছে। মশাল উত্সবের কারণে অধিকাংশ লোক ই জাতি সম্পর্কে জানে। প্রাচীনকাল থেকেই ই জাতি মশালকে সম্মান করে। পাথরবনের ই জাতি'র লোক-রীতি গ্রামের একজন বয়স্কামহিলা আমাদের জানিয়েছেন, প্রতি বছর মশাল উত্সবের রাতে, গ্রামীণ লোকজন পাইন গাছের মশাল প্রজ্বলিত করে, দূর দূরান্তের শস্যের ক্ষেত পার হয়ে যায়।
বৃদ্ধার কথা অনুযায়ি, মশাল ধরে শস্যের মাঠ দিয়ে হেটে যাওয়ায় ক্ষতিকর পোকামাকড়কে হত্যা করা যায়, যার ফলে শরতকালে প্রচুর ফলন হয়। মানুষ বাকি মশাল বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাতে এক ধরনের শিম পুড়িয়ে পরিবারের সবাইকে খাওয়ান। 'মশাল শিল' খেলে, সারা বছর নিরাপদে থাকবেন। ই জাতির ছেলে আং কুই আমাদের জানিয়েছেন, পাথরবনের ই জাতির মানুষ 'মশাল উত্সব'কে সবচে' বড় উত্সব মনে করেন। উত্সবের রাতে, সব পরিবারের মানুষ এক সঙ্গে উত্সব উদযাপন করেন। তিনি বলেছেন,
মশাল উত্সবের দিন, সকল পরিবারের সদস্যরা মশাল নিয়ে বাইরে যান। চান্দ্র মাস হিসেবে ২৪ জুন সারা রাত, তরুণ ও বয়স্ক, পুরুষ ও মহিলা সবাই উত্সবটি উদযাপন করেন। দিনের বেলায়, মানুষরা উত্তেজিত ষাঁড়ের লড়াই এবং কুস্তিসহ বিভিন্ন কর্মসূচীর আয়োজন করেন।
পাথরবন দর্শনীয় স্থানে মশাল উত্সবের দিন, খুব ভোরে মানুষ চার দিক থেকে এখানে আসেন। দুপুরে, সুন্দর পোশাক পরা তরুণ-তরুণী ছেলেমেয়েরা মহাচত্বরে এসে, গান গাওয়া এবং নৃত্য শুরু করেন। হঠাত্ করেই মহাচত্বর আনন্দ সমুদ্রে পরিনত হয়ে যায়।
|