মে মাস । অথচ ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে বসন্তের একটু লক্ষণও পাওয়া যাচ্ছে না । সংবাদদাতারা মোটর গাড়িতে করে তিব্বতী পশু পালক কারসিছারের বাড়িতে যাচ্ছিলেন । গাড়ি কনকনে হাওয়া উপেক্ষা করে চলল । এক ঘন্টারেরও বেশি লাগল ।
কারসিছারের বাড়ি ছিংহাই হ্রদের উত্তর তীরের সিংফু তৃণভূমিতে অবস্থিত । এ অঞ্চল সমুদ্র-সমতলের তুলনায় প্রায় ৩ হাজার মিটার উঁচুতে । মে মাসে নদীতেও বরফ গলে যায় নি । তৃণভূমিতে সবুজ রঙ দেখা যায় নি , হলুদ রঙ দেখাচ্ছে । যখন সংবাদদাতারা কারসিছারের বাড়িতে পৌঁছলেন , তখন অতিথিপরায়ন কারসিছার অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্য দরজার সামনে দাঁড়ালেন ।
কারসিছারের বাড়িতে মোট ৯টি কক্ষ আছে । সব জানালায় কাচ লাগানো । যদিও বাইরে কনকনে হাওয়া বইচ্ছে , তাপমাত্রাও অল্প ছিল , কিন্তু কক্ষের ভিতরে গরম অনুভব করা হচ্ছে ।
বড় ও উজ্জ্বল বৈঠকখানায় বিবিধ উন্নত মানের ইলেকট্রনিকস্ ও নতুন আসবাবপত্র আছে । টেবিলে নানা রকম জলখাবার পড়ে আছে । তেলে ভাজা মুসলমানদের এক ধরনের জনপ্রিয় খাবার ভীষণ সুগন্ধ ছড়াচ্ছে । অতিথিদের প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে ৫৭ বছর বয়স্ক গৃহকর্তা তৃণভূমি ও তার পরিবারের জীবনযাপনের পরিবর্তন প্রসঙ্গে বলতে শুরু করলেন ।
১৯৮৯ সালে তার বাসা এই অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয় । তাদের পূর্বপুরুষরা যুগ যুগ ধরে তাবুতে থাকতেন । সুতরাং প্রথম দিকে তারা অভ্যস্ত হন নি । কিন্তু এখন তারা খুব সুবিধা অনুভব করছেন । বিশেষ করে তাদের খাওয়া দাওয়ার বিরাট পরিবর্তনও হয়েছে । আগে দিনের তিন বেলায় প্রধান খাবার হিসেবে তারা গরুর মাংস ও খাসি এবং চেনপা নামে এক ধরনের খাবার খেতেন । এখন এগুলির পরিবর্তে তারা প্রধানতঃ শাক-সবজি ও ময়দা দিয়ে তৈরী অন্যান্য খাবার খান ।
তিব্বতীদের খাওয়া দাওয়ার রীতি-নীতি অনুসারে অতিথিদের সাধারনতঃ প্রচুর গরুর মাংস ও খাসি খাওয়ানোর কথা । কিন্তু সে দিন অতিথিদের খাওয়ানোর জন্য গৃহকর্তার পরিবারের সদস্যরা নানা রকম সবজি দিয়ে ব্যঞ্জন রান্না করলেন । কারসিছারের বাসা জেলা শহর থেকে অনেক দূরে । শাক-সবজি কেনার জন্য খুব অসুবিধা হয় । গরমকালে সব গরু ও ছাগল বাইরে পালন করা হয় । তাই শীতকালে ব্যবহার্য গোয়াল ঘরের প্রয়োজন হয় না । এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সবজি চাষ করা হয় ।
কারসিছারের নিজস্ব তৈরী শাক-সবজি যেমন নিজের চাহিদা মেটাতে সক্ষম , তেমনি তিনি সেগুলি প্রতিবেশীদেরও উপহার দেন । কারসিছার সংবাদদাতাদের জানান , জীবনধারা ও খাবার বিষয়ক আচার ব্যবহার পরিবর্তনের কারণে পশু পালকদের গেঁটেবাত ও গ্যাস্টিক আলসার রোগের মতো বহু ক্রণিক রোগ কমে গেছে । কারসিছার অতিথিদের সঙ্গে গল্প করছিলেন । তার পুত্রবধূ লামোটসো রান্না ঘরে পাক করছেন । তিনি বলেন ,
গত কয়েক বছরে পশু পালকদের জীবনযাত্রার মান আনেক উন্নত হয়েছে । তারা পাহাড়ী অঞ্চলে বসবাস করেন । কিন্তু সরকারের সাহায্য ও নিজেদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে চিরস্থায়ী থাকার জন্য তাদের সুষ্ঠুভাবে পুনর্বাসন করা হয়েছে । পশু পালকদের বিদ্যুত্ ও কলের পানি সরবরাহ করার ক্ষেত্রে গত বছর সরকার অর্থ বরাদ্দ করেছে । এখন পশু পালকদের আবাসিক এলাকায় বিদ্যুত্ ও কলের পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে ।
কয়েক দশক আগেও তৃণভূমির দুরূহ আবহাওয়া ও পশু পালকদের আবাস বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকতো বলে তাদের জীবনযাপনের অবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত ছিল । বহু জায়গায় বিদ্যুত্ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল না এবং অন্ন-বস্ত্র সমস্যারও নিষ্পত্তি করা যেতো না । বর্তমানে তৃণভূমিতে পশু পালকদের জীবনযাত্রা ও আচার ব্যবহারের পরিবর্তন হয়েছে এবং চিরস্থায়ী থাকার জন্য সরকারের সাহায্যে তাদেরকে পুনর্বাসন করা হয়েছে । স্থানীয় সরকারের সাহায্য ও নিজেদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের জীবনযাপন এখন অনেক স্বচ্ছল হয়ে উঠেছে ।
কারসিছার সংবাদদাতাদের বলেন , তার বাড়িতে মোট ১ হাজার ২ শো ছাগল ও ১৭০টি গরু পালন করা হচ্ছে । গত বছর গরু ও ছাগল বিক্রি করে তিনি ৬০ হাজার ইউয়ানেরও বেশি আয় করেছেন । গত বছর তিনি জেলা শহরের আবাসিক এলাকায় ছেলের জন্য একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য ৮০ হাজার ইউয়ানেরও বেশি খরচ করেছেন ।
কারসিছার একটি আবাসিক এলাকায় তিন কক্ষ বিশিষ্ট একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন । তার নতুন বাসার আয়তন ৮০ বর্গ মিটারেরও বেশি । বাসায় আসবাবপত্র ও নিত্য দিনের ব্যবহার্য পণ্যদ্রব্য আছে । বাসাটি দেখতে শহুরে অধিবাসীদের বাসার সঙ্গে কোন পাথর্ক্য নেই । শুধু তিব্বতী দেয়াল চিত্র ও বৌদ্ধ মূর্তি থেকে বোঝা যায় এটাই তিব্বতীদের বাসা । কারসিছারের স্ত্রী হারমো সংবাদদাতাদের বলেন , তৃণভূমিতে নারীরা সবচেয়ে পরিশ্রমী ছিলেন । যেহেতু পশুপালকদের চিরস্থায়ী আবাস ছিল না , সেহেতু পশু পালনের জন্য তাদের যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে হতো । বাইরের কাজ ছাড়া তাদের স্বামী ও সন্তানদেরকেও দেখাশুনা করতে হতো । সুতরাং তাদের শরীরের অবস্থা সাধারনতঃ দুর্বল ছিল । এখন তারা বড় ও উজ্জ্বল বাসায় বসবাস করছেন । বাসায় রেফ্রিজারেটরসহ ইলেকট্রনিকস দ্রব্য আছে ।
পশু পালকদের জীবনযাপন স্বচ্ছল হয়ে উঠেছে । কারসিছার ও তার স্ত্রী আনন্দের সঙ্গে তিব্বতী গান গাইতে শুরু করছেন ।
তৃণভূমির অন্যান্য পশু পালকদের মতো জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার পাশাপাশি কারসিছার ও তার পরিবার পরিজনের সাংস্কৃতিক জীবনের চাহিদাও বেড়ে গেছে । কারসিছারের বড় ছেলে ও জামাই জেলার ঘোড় দৌড় প্রশিক্ষণ দলে যোগ দিয়েছেন । তার কন্যা ও পুত্রবধূ বাদ্য যন্ত্র বাজাতে শিখেছেন । প্রতি দিন অবসর সময় তারা এক সাথে বাদ্য যন্ত্র বাজান এবং গান করেন । তার ৫ বছর বয়সী নাতীও বাবা মায়ের সঙ্গে গান করে ।
|