গত দশ বারো বছরে চীনের পর্যটন শিল্পের বিরাট প্রসার হয়েছে । শুধু বিভিন্ন বিখ্যাত শহরে নয় , চীনের অনেক স্থানের গ্রামগুলোতেও পর্যটন শিল্পের উল্লেখযোগ্য প্রসার হয়েছে । আজকের অনুষ্ঠানে মধ্য চীনের চিয়াং সি প্রদেশের চি আনের গ্রাম ভ্রমণের উপর একটি বিশেষ প্রতিবেদন পরিবেশন করছি আমি শি চিং উ । এখানে আপনারা যেমন নিজেরা নানা ধরণের চাষাবাদ করতে পারবেন , তেমনি ড্রাগণ নৌকার প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিতে পারবেন ।
চি আনের গ্রামগুলোতে মেই পোও গ্রাম সবচেয়ে বিখ্যাত । মেই পোও গ্রাম চি আনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত । এর আয়তন এক বর্গকিলোমিটার মাত্র । আয়তন অল্প হলেও এর ৮ শ'রও বেশি বছরের ইতিহাস রয়েছে । মেই পোও গ্রামের মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সাদা মার্বলের একটি তোরণ । এতে লেখা রয়েছে মেই পোওয়ের চীনা শব্দ । এ তোরণ পার হয়ে আপনারা মেই পোওয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন ।
মেই পোও গ্রামে প্রবেশ করলে পর্যটকরা দেখতে পাবেন গ্রামবাসীদের পরিবেশিত ছাই ছিং নামক এক রকম অভিনয় । তারা প্রায় প্রতিদিন ছাই ছিং অভিনয় করে থাকেন । এ গ্রামের ছেলেমেয়েরাই এ ছাই ছিংয়ের অভিনেতা-অভিনেত্রী । এসব ছেলেমেয়ে অপেরার পোষাক পরে এবং নানা ধরণের মুখোশ পরিধান করে ইতিহাসের গণমান্য ব্যক্তি ও বিভিন্ন অপেরার চরিত্রে অভিনয় করে । তাদের পাগুলো কাঠের ফ্রেমের সংগে বেঁধে রাখা হয় । কয়েকজন বয়স্ক গ্রামবাসী এ ফ্রেমগুলো বহন করে লোক সংগীত দলের বাজানো সুরের তালে তালে আস্তে আস্তে অগ্রসর হয় । দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসা পর্যটক পার্ক জুং শু এত চমত্কার অভিনয় দেখে অত্যন্ত অভিভূত হয়ে পড়েছেন । তিনি বলেন ,
আমি ভাবতে পারি নি যে, চি আনের মেই পোওয়ের ছাই ছিং এত চমত্কার । তাছাড়া এখানে আরো রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন চীনের সংস্কৃতির নিদর্শন- উপাসনালয় ও প্রাচীন রাস্তা । এখানে আমি চীনের মিং ও ছিং রাজবংশ আমলের গ্রামকে দেখতে পেয়েছি যা আগে আমি কোনোদিন দেখি নি । খুব পরিপাটি করে সাজানো । আমি সত্যিই এ জায়গাকে পছন্দ করি । এখানকার কথা আমি নিশ্চয় আমার বন্ধুদের বলবো ।
মেই পোও গ্রাম দক্ষিণ চীনের প্রাচীন গ্রাম যাদুঘর নামে পরিচিত । এ গ্রামে এখনো ৫০৩টি আবাসিক বাড়ি , ১৯টি প্রাচীন উপাসনালয় , ৮টি প্রাচীন গ্রন্থাগার ও প্রাচীন তোরণ ভালোভাবে সংরক্ষিত রয়েছে । মেই পোও গ্রামের উত্তর দিকে প্রায় এক হাজার মিটার লম্বা এস আকারের একটি প্রাচীন রাস্তা আছে । এর ইতিহাস ৫ থেকে ৬ শ' বছরের পুরনো । এ প্রাচীন রাস্তা৩ মিটারের একটু বেশি চওড়া মাত্র । রাস্তাটি পরোপুরিই পাথর দিয়ে তৈরি । স্থানীয় বৃদ্ধবৃদ্ধারা বলেছেন , এটি একটি বাণিজ্যিক রাস্তা ছিল । এক সময় এখানে শতাধিক দোকানপাট বসতো । এ রাস্তার দু পাশের বাড়িঘরের দেয়ালে দেয়ালে এখনো অস্পষ্টভাবে চাল বা তেলের মত বিজ্ঞাপনের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় । এ চিহ্নগুলো থেকে তখনকার ব্যস্ততম দৃশ্যের কথা অনুমান করা যায় ।
পর্যটকরা মেই পোও গ্রামের প্রাচীন রাস্তা ভ্রমণের পাশাপাশি নিশ্চয় রাস্তাটির দু পাশের প্রাচীন বাড়িঘরে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাইবেন । এ বছর মেই পোও গ্রাম বিশেষভাবে প্রাচীনকালের বাড়ি অনুকরণে দশ বারোটি মোটেল নির্মাণ করেছে । এ মোটেলগুলো মেই পোও গ্রামের কাছাকাছি নির্মিত হয় । এটি পর্যটকদের ভ্রমণ এবং গ্রামটির প্রাচীন স্থাপত্য সংরক্ষণের জন্যে অনেক সুবিধা দিয়েছে । লিয়াং সিং ফা হলেন মেই পোও গ্রামের একজন কৃষক । তিনি বলেছেন , গ্রামটির বাইরে মোটেল নির্মাণের বিশেষ তাত্পর্য রয়েছে । তিনি বলেন ,
একক পরিকল্পনায় গ্রামের বাইরে বিভিন্ন মোটেল নির্মাণ যেমন প্রাচীন গ্রামের আগেকার চেহারা সংরক্ষণ , তেমনি আমাদের মোটেলগুলোর পরিচালনার পক্ষেও কল্যাণকর ।
চি আনের লুই চৌ গ্রামও একটি সুপরিচিত দর্শনীয় স্থান । এ গ্রাম লুই চৌ দ্বীপে অবস্থিত । এর আয়তন ৪.৫ বর্গকিলোমিটার । লুই চৌ গ্রামে যেতে হলে নৌকায় করে যেতে হয় । লুই চৌ দ্বীপের জাহাজঘাটা প্রাচীনকালের বারান্দা স্টাইলের স্থাপত্য । পর্যটকরা এ দীর্ঘ বারান্দার পাথরের চেয়ারে বসে ভ্রমণ নৌকার জন্যে অপেক্ষা করার সংগে সংগে চারদিকের প্রাকৃতিক নিসর্গ উপভোগ করতে পারেন ।
লুই চৌ দ্বীপের ৮০ শতাংশ ভূমি আদি জংগল ও কমলার বনে আবৃত । লুই চৌ দ্বীপের চারদিকে রয়েছে ৩.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বেলাভূমি । বেলাভূমিতে ছড়িয়ে রয়েছে সাদা ও সূক্ষ্ম বালি । এটি মিঠা পানির একটি প্রাকৃতিক স্নানাগার । লুই চৌ দ্বীপ থেকে নৌকায় করে পশ্চিম দিকে গেলে নদী পার হওয়ার পর তিয়ান চিয়াং থাই নামক একটি পুরাকীর্তি আছে । এর ৮ শ'রও বেশি বছরের ইতিহাস রয়েছে । প্রাচীনকালে অভিযান শুরু হওয়ার আগে সেনাপতিরা এখানে দাঁড়িয়ে সৈনিকদের বাছাই করতেন । নদী বেয়ে সামনে গেলে একটি নীল তামা যাদুঘরে যাওয়া যায় । যাদুঘরে ৩ হাজার ৭০০ বছরের আগেকার নীল তামার পুরাকীর্তি প্রদর্শিত হয় । নদীর উত্তর পারে রয়েছে প্রখ্যাত প্রাচীন সান হু নগর । এখানে উত্পন্ন তা হুং পাও নামক কমলা এ প্রাচীন নগরের জন্যে সুনাম অর্জন করেছে । এ রকম কমলার খোসা পাতলা এবং স্বাদ মিষ্টি । প্রাচীন চীনে এ কমলাগুলো কেবল রাজপরিবারে সরবরাহ করা হতো । আজ প্রতি বছরের অক্টোবর মাসে কমলা পেকে যাওয়ার সময় লুই চৌ গ্রামে ধুমধামের সংগে লুই চৌ কমলা উত্সবের আয়োজন করা হয় ।
লুই চৌ গ্রামের ড্রাগণ নৌকা বাইচ পর্যটকদের আকৃষ্ট করে থাকে । পর্যটক কুয়াং চিয়ান ইয়ু উত্তর চীনের অন্তর্মংগোলিয় স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল থেকে এসেছেন । ড্রাগণ নৌকা বাইচে অংশ নেয়ার পর তিনি খুবই আনন্দিত হয়েছেন । তিনি বলেন ,
আমাদের অন্তর্মংগোলিয়ার বিশাল তৃণভূমিতে এখানকার চাষাবাদ নেই । বিশেষ করে এখানে ড্রাগণ নৌকা বাইচ আছে । তাই আজ আমি খুব খুশী ।
লুই চৌ গ্রামে পর্যটকরা বিভিন্ন চাষাবাদ করা ছাড়াও স্থানীয় রীতিনীতির বিয়ে অনুষ্ঠান ও বনভোজনসহ নানা ধরণের তত্পরতায় অংশ নিতে পারেন । ক্যানাডার পর্যটক এরিক ক্ল্যাপ বলেছেন ,
ও মাইক , এসো , এসো , আমাকে সাহায্য করতে আসো । লিনা আমাদের ছাড়িয়ে গেছে । শুধু দেখলে চলবে না । আমার কাছে আসো । বেশ মজা আছে । আমি নিশ্চিত যে , তুমি এ খেলা পছন্দ করবে ।
|