ছাও হোং একজন সাহসী ও জ্ঞানী প্রেস ফটোগ্রাফার । তিনি চীনের সেনচেন সংবাদপত্র গ্রুপে কাজ করেন । তিনি চীনের ফটোগ্রাফিতে স্বর্ণ পদকপ্রাপ্ত প্রথম চীনা নারী । একজন প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবে তিনি ১৭ বছর ধরে ক্যামেরা যুগ এবং জীবন সম্পর্কে ছবি তুলে আসছেন ।
ছাও হোং উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিভাগে ফটোগ্রাফিবিষয়ের ছাত্রী ছিলেন । পড়াশুনার সময় একজন যুদ্ধ সাংবাদিক হওয়া তার স্বপ্নছিল । কিন্তু শান্তির সময় এমন সুযোগ খুব কম । বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর ছাও হোং সেনচেন শহরে আসেন । তিনি যুদ্ধ সাংবাদিক না হলেও বিপদ্জনক ও আকস্মিক ঘটনায় তখন তিনি সাহসের সঙ্গে আগেই ঘটনাস্থলে হাজির হন ।
এক দিন দুপুর বেলায় ছাও হোং তার ৬তলা অফিসে ফিরে খাবার খাওয়া শুরুমাত্রই দু'টি আওয়াজ শুনতে পান । নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ছাও হোং নিশ্চিত করেন , এটি গুলি বিনিময়ের আওয়াজ । তিনি সঙ্গেসঙ্গে বারান্দায় গিয়ে নিচে তাকান । তিনি দেখতে পান , বাইরে একটি বড় গাড়ি , ৫-৬ জন লোক চার দিকে পালিয়ে যাচ্ছে এবং পিছনে সাধারণ পোশাক পরিহিত পরা পুলিশ তাদের ধাওয়া করছেন। এই দৃশ্য দেখে ছাও হোং তাড়াতাড়ি ক্যামেরা নিয়ে ৬তলা থেকে নিচে নেমে যান । তিনি বিপদ উপেক্ষা করে পুলিশদের অনুসরণ করলেন । তিনি পুলিশদের অপরাধীদের ধরার গোটা প্রক্রিয়া ক্যামেরাবন্দী করেন। নিজের সাহস ও অধ্যবসায়ের উপর নির্ভর করেই ছাও হোং ধারাবাহিক জীবন্ত ও মর্মস্পর্শী ছবি তুলেন । ছাও হোং বলেন, আকস্মিক ঘটনাগুলো স্মরণ করলে তার এখনও ভয় লাগে । কিন্তু ঘটনার সময় আমি শুধু নিজেকে বলতাম, সামনে অগ্রসর হও ।
নিজের ছবিগুলো থেকে ছাও হোং একজন যুদ্ধ-সাংবাদিক হওয়ার অনুভূতি অনুভব করেছেন ।তিনি সহকর্মী ও পাঠকদের স্বীকৃতি পেয়েছেন ।ঠিক এই সময় ছাও হোংয়ের ছবি তোলার পদ্ধতি একটি সাক্ষাত্কারের দরুণ পরিবর্তন হয় । "বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পত্র" সংস্থায় স্থানান্তরিত হওয়ার কিছু দিন পরের কথা । এক দিন তিনি একটি ফোন পেলেন । ফোনে এক পাঠক জানান , সেনচেন শহরের কোন একটি গাড়ি পরিচালনা কেন্দ্রে গাড়ি আটক করার মাধ্যমে বে-আইনিভাবে ফি আদায় করা হয় । ছাও হোং মনে করেন , কেন্দ্রটিতে হয়ত কোন কিছু গোপনীয়ভাবেবিনিময় করা হয় । অবৈধ বিনিময় ধরতে চাইলে ছবি তোলা শুধু গোপনীয়ভাবে চালাতে হবে । ছাও হোং এবারের ছবি তোলার জন্য অনেক প্রস্তুতি নেন । সে দিন ছাও হোং অনেক আগে ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছান ।দূর থেকে অবৈধ বিনিময়ের দৃশ্য তুলে ধরার জন্য তিনি জায়গা বেছে নিলেন এবং গাড়িতে ক্যামেরা বসালেন । কিন্তু এ সময় অভিযুক্ত পাঠক ফোনে জানান, বিনিময় তার অফিসে হবে । ছাও হোংয়ের পরিকল্পনা বিফল হয় । ছাও হোং শিগ্গীরই বন্ধু হিসেবে অভিযুক্ত পাঠকের অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন । মাত্র কয়েক বর্গ মিটারের অফিসে উত্তেজনাময় পরিবেশ ভরপুর । কি হতে পারে কেউই জানে না । দুপক্ষের অবৈধ বিনিময়ের প্রক্রিয়া ক্যামেরাবন্দী করার জন্য ছাও হোং ১৭-৩৫ ক্যামেরা বেছে নেন । তিনি গোপনে গোপনে সুযোগ খুঁজতে থাকেন । তিনি ভয় পান যে, ছবি তোলার সময় ক্যামেরার আওয়াজে নিজের আসল পরিচয় ফাস হয়ে যায় কি না । যখন তিনি একটি ছবি তোলেন তখন ক্যামেরার আওয়াজ তার কাছে মনে হয় যেন বোমার বিস্ফোরণ । মন থরথর করে কেঁপে ওঠে ।
দ্বিতীয় দিন পাঠকরা ছবিগুলোর মাধ্যমে ওই অবৈধ বিনিময়ের প্রক্রিয়া দেখতে পান । গাড়ী আটক করা এবং ফেরত্ দেয়ার মাধ্যমে গাড়ীর মালিকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করার এই অবৈধ বিনিময় ছাও হোং সাফল্যের সঙ্গে উদ্ঘাটন করেছেন । সাংবাদিক হিসেবে ছাও হোং নিজের সাফল্যের জন্য গর্বিত ।
দীর্ঘকাল ধরে সাংবাদিকতার কাজের মাধ্যমে ছাও হোং নানা সামাজিক সমস্যাও উপলব্ধি করেছেন । অনেক লোকেরঅনেক কাজ ছাও হোংকে মুগ্ধ করেছে । তিনি এগুলোতে মানবজগতের সৌন্দর্য অনুভব করতে পেরেছেন । ২০০৩ সালের একদিন সেনচেন শহরের একটি হাসপাতালের একজন ডাক্তার তাকে ফোন করেন । ফোনে তিনি ছাও হোংকে তাদের হাসপাতালের প্রবীণ পরিচালক কো ছুনইয়ুনের কাহিনী প্রচার করতে অনুরোধ করেন । অস্থি বিভাগের একজন ডাক্তার হিসেবে কো ছুনইয়ুন দীর্ঘকাল ধরে এক্স রশ্মির স্পর্শে ক্যান্সারে আক্রান্ত । এই ডাক্তারের বর্ণনা শুনে ছাও হোং খুব মুগ্ধ হন । হাসপাতালে সাক্ষাত্কার নেয়ার সময় ছাও হোং অনুভব করেন , কো ছুনইয়ুন এক অভিজ্ঞ ডাক্তার । তার চিকিত্সার মান উন্নত, তিনি অনেক গুণাবলিসম্পন্ন এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি । মুমূর্ষুকালে তিনি রোগীদের চিকিত্সা করার কথা ভাবেন । ছাও হোং আবার ক্যামেরা নিয়ে হাসপাতালে আসেন । যখন তিনি কো ছুনইয়ুনের রুমের দরজা খুলে দেন, তিনি আকস্মিকভাবে লক্ষ্য করেন , গুরুতর অসুস্থঅবস্থায় থাকলেও প্রবীণ ডাক্তার কো দু' হাত তুলে যেন রোগীদের ফিল্ম দেখছেন । ছবি তোলার সময় ছাও হোংয়ের চোখ দুটোঅশ্রুতে ভরে যায় ।এ জীবনে তিনি প্রথমবার ক্যামেরার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবন উপলব্ধি করেন ।
এবারের ছবি তোলার পর ছাও হোং মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি সাধারণ মানুষের সুখ ও দুঃখ অনুভব করতে এবং প্রতিটি সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেন । তিনি কৃষিশ্রমিকদের বেতনের জন্য প্রচেষ্টা চালান, অনাথ ছেলেমেয়েদের সাহায্য করেন । মাদকদ্রব্য সেবনকারীদের নেশামুক্তকরণেসাহায্য করেন । ধারাবাহিক ছবি তোলার মাধ্যমে প্রয়াত গায়ক ছুং ফির কাহিনী প্রচার করেন । ক্যামেরার মাধ্যমে তিনি মনুষ্য-প্রকৃতির উপর গুরুত্ব দেন । এ কারণে তিনি চীনের ফটোগ্রাফারদেরসর্বোচ্চ পুরস্কার—চীনের ফটোগ্রাফের স্বর্ণ পদক পান । তিনি এই পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম নারী । সম্মান ও গৌরবের সম্মুখীন হয়ে ছাও হোং হেসে হেসে বলেন , আমি তেমন ধনী নই । কিন্তু আমার একটা ক্যামেরা আছে । সমাজ আমার উপরে এক মহত দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে । এটা একজন সংবাদদাতার করণীয় কাজ ।
|