কিছুদিন আগে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ইয়ুন নান প্রদেশের রাজধানী খুন মিং শহরে অনুষ্ঠিত সপ্তম চীনা প্রতিবন্ধীদের গেমসে একবাহুর একজন তরুণ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । তিনি বেশ লম্বা এবং সুদর্শন । তিনি বেশ কয়েকবার তার নিজের সৃষ্ট প্রতিবন্ধীদের সাঁতার প্রতিযোগিতায় বিশ্ব রেকর্ড ভংগ করেছেন । তিনি হলেন ১৯ বছর বয়সের ওয়াং সিয়াও ফু ।
প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার সংগে সংগে ওয়াং সিয়াও ফু দক্ষতার সংগে সুইমিংপুলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন । অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সবার ভাগে চলে গেলেন । তার প্রতিযোগিতা দেখে সত্যিই একটি উপভোগ করার মত । এবারের চীনা প্রতিবন্ধীদের গেমসে ওয়াং সিয়াও ফু সাঁতার প্রতিযোগিতার যাবতীয় ৯টি বিভাগে অংশ নিয়ে ৭টি বিভাগে শিরোপা অর্জন করেছেন । তার মধ্যে তিনি পুরুষদের ১০০ মিটার বাটারফ্লাই ও ২০০ মিটার ফ্রি স্টাইল সাঁতারে তার নিজের সৃষ্ট বিশ্ব রেকর্ড ভংগ করেছেন ।
ওয়াং সিয়াও ফু ইয়ুন নান প্রদেশের ইয়ু সি শহরের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । ছোটবেলায় একটি উচ্চচাপসম্পন্ন বিদ্যুত তারে স্পৃষ্ঠ হয়ে তিনি একটি বাহু হারান । যখন তার বয়স ১১ বছর ছিল , তখন কোর্চ চাং হুং হাও ইয়ুন নান প্রদেশের প্রতিবন্ধী খেলোয়াড় বেছে নেয়ার সময় তাকে পছন্দ করেন এবং তাকে প্রাদেশিক রাজধানী খুন মিং শহরে নিয়ে যান । তখন থেকে তিনি একদিকে লেখাপড়া করেন , অন্যদিকে সাঁতারের প্রশিক্ষণ নেন । তিনি বলেছেন ,
প্রাদেশিক সাঁতার টিমে প্রবেশের আগে আমি কোনোদিন পানিতে নামি নি । প্রথমবার পানিতে নেমে আমার খুব ভালো লাগল । সুইমিংপুলে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর আমি শুধু হাত পা দিয়ে এদিক ওদিক করে পানি ঠেলে দিতাম । যখন আমি প্রায় সুইমিংপুলের তলদেশে ডুবে যেতাম , তখন আমার কোর্চ আমাকে একটি লাঠি দিয়ে আমাকে টেনে তুলতেন ।
সাঁতার করতে চাইলে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন । ওয়াং সিয়াও ফুর রয়েছে মাত্র একটি বাহু । তাছাড়া তিনি আগে কোনোদিন সাঁতার কাটেন নি । তাই একজন ভালো সাঁতারু হওয়া তার জন্যে নিসন্দেহে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ । কোর্চের পরিচালনায় ওয়াং সিয়াও ফু প্রথমে পানিতে নিজের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রশিক্ষণ নেন । তারপর তিনি শক্তি ব্যবহার ও বিভিন্ন স্টাইলের সাঁতার শিখতে শুরু করেন । এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই বুদ্ধিমান সিয়াও ফু সাঁতার কাটতে সক্ষম হন ।
তারপর তিনি প্রতিদিন ১০ হাজার মিটার সাঁতার কাটতে শুরু করেন । একটি দশ বারো বছরের পংগু ছেলের জন্যে এটি সহজ কথা নয় । কোর্চ চাং হুং হাও পর্যন্ত তার অদম্য মনোবলে বিমোহিত হয়েছেন । তিনি বলেছেন ,
একজন ভালো খেলোয়াড় হতে হলে নিজের মেধা ছাড়া তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে । সে খুব ভালো ছেলে । প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় সে বেশ কষ্ট স্বীকার করতে পারে । প্রতিদিন তাকে ১০ হাজার মিটার সাঁতার কাটতে হয় । এত ভারী বোঝা দু একদিন সহ্য করা যায় । কিন্তু সারা বছর এ রকম প্রশিক্ষণ নিলে খেলোয়াড়দের অবশ্যই অদম্য মনোবল ও প্রত্যয় থাকতে হবে ।
চার মাস পর কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পাহাড়ী এলাকা থেকে আসা এ ছেলেটি প্রাদেশিক প্রতিবন্ধীদের গেমসে শিরোপা লাভ করেন । দু বছর পর অর্থাত ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার পুসানে অনুষ্ঠিত দূরপ্রাচ্য ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রতিবন্ধীদের গেমসে ওয়াং সিয়াও ফু ৫টি সাঁতার বিভাগে স্বর্ণপদক জয় করেছেন এবং এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় নির্বাচিত হন । ২০০৪ সালে এথেন্সে অনুষ্ঠিত প্রতিবন্ধীদের অলিম্পিকে তিনি আবার পুরুষদের ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল সাঁতারসহ তিনটি বিভাগে শিরোপা অর্জন করেন ।
একের পর এক কৃতিত্ব ওয়াং সিয়াও ফুর জন্যে এনে দিয়েছে নানা ধরণের মর্যাদা ও পুরস্কার । তিনি ইয়ুন নান প্রদেশের বিশিষ্ট যুবক ও শ্রমবীরের সম্মানে ভূষিত হন । ইয়ুন নান প্রদেশের শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভর্তি করে ।
এসব মর্যাদা ও সম্মান লাভের পর কিছু সময়ের জন্যে ওয়াং সিয়াও ফু একটু আত্মহারা হয়ে গেলেন । একসময় তিনি সারাদিন ওয়েবসাইটের খেলায় বিভোর ছিলেন । তার প্রশিক্ষণ অনেক শিথিল হয়ে গেল । অস্ট্রেলিয়ার একজন সাঁতারু তার বজায় রাখা একটি বিশ্ব রেকর্ডও ভংগ করেছিলেন ।
কোর্চ চাং হুং হাও ওয়াং সিয়াও ফুর পরিবর্তন দেখতে পেয়েছেন । তিনি আরো বেশি সময় ব্যয় করে জীবনের দিক থেকে তার যত্ন নেন এবং ধৈর্য্যের সংগে তাকে বুঝিয়ে বলেন । কোর্চ চাংয়ের পরিচর্যায় ও সাহায্যে সিয়াও ফু আস্তে আস্তে জীবনের নিম্ন উপত্যকা থেকে বেরিয়ে আবার প্রত্যয় প্রতিষ্ঠা করেন । এ সময়ের মধ্যে কোর্চ চাং তার অন্তরংগ বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়েছেন । ওয়াং সিয়াও ফু বলেছেন ,
আমার কোর্চ আমাকে সবচেয়ে ভালো করে জানেন । আমি কিছু না বললেও তিনি জানেন যে , আমি কি ভাবছি । মনে কিছু থাকলে আমি তাকে বলি । সেই সময় তিনি বরাবরই আমাকে উত্সাহ দিয়ে আসছিলেন ।
ওয়াং সিয়াও ফুর এ অগ্রগতি দেখে কোচ চাংও মনের অন্তর্স্থল থেকে আনন্দিত । তিনি আমাদের সংবাদদাতাকে বলেছেন , একবাহু হারানো সাঁতারুর জন্যে তার সাফল্য সহজ নয় । তিনি বলেছেন ,
অনেক সাঁতারুর দুটো বাহু আছে । আবার কিছু সাঁতারুর পংগুত্বের মাত্রা তার চেয়ে অনেক কম । অথচ তিনি তাদেরকেও পরাজিত করেছেন । অস্ট্রেলিয়া ও বৃটেনসহ বেশ কিছু দেশের বিশিষ্ট সাঁতারুরা তার প্রশংসা করেছেন ।
ওয়াং সিয়াও ফু পাহাড়ী এলাকায় বসবাসকারী একজন গ্রামীণ কিশোর থেকে এখন একজন বিশ্ববিখ্যাত সাঁতারুতে পরিণত হয়েছে । তার সাফল্য যেমন তার নিজের মেধা ও একজন যত্নবান কোর্চের সংগে জড়িত , তেমনি তার উপর সরকারের আন্তরিক পরিপর্যার সংগেও জড়িত । চীনে বিভিন্ন স্থানের প্রতিবন্ধী সংগঠন ক্রীড়া পরামর্শ কেন্দ্র স্থাপন করে । এসব কেন্দ্র ওয়াং সিয়াও ফুর মত বহু সাধারণ প্রতিবন্ধীকে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়রূপে গড়ে তুলেছে । ইয়ুন নান প্রদেশের প্রতিবন্ধী ক্রীড়া পরামর্শ কেন্দ্রের পরিচালিকা ফান লি চিং আমাদের সংবাদদাতাকে বলেছেন ,
সরকার বিপুল অংকের টাকা বরাদ্দ করে প্রতিবন্ধীদের জন্যে কোর্চদের নিয়োগ করে এবং নানা দিক থেকে তাদের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে । খাওয়া-দাওয়া , থাকার ব্যবস্থা , স্টেডিয়াম এবং প্রশিক্ষণের সরঞ্জামের ক্ষেত্রে সরকার সব রকমের সুযোগ সুবিধা দিয়েছে , যাতে প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়রা নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে পারেন ।
সাঁতার ওয়াং সিয়াও ফুর স্বভাবেরও পরিবর্তন করেছে । তিনি বলেছেন , আমি দেখতে পাচ্ছি যে , আমার মত অনেক প্রতিবন্ধী সবসময় আনন্দে উত্ফুল্ল থাকে । আমিও তাদের মত থাকতে চাই ।
|