বর্তমানে চীনে রয়েছে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখেরও বেশি বুদ্ধির প্রতিবন্ধী। সরকার ও সমাজের বিভিন্ন মহলের লোকেরা আন্তরিকভাবে তাদের যত্ন নিচ্ছেন । আজকের অনুষ্ঠানে আমরা আপনাদেরকে পূর্ব চীনের শাংহাই শহরে বুদ্ধির প্রতিবন্ধীদের জন্যে গড়ে তোলা সূর্যালো পরিবারে নিয়ে যাবো । এসব পরিবার বুদ্ধির প্রতিবন্ধীদের বিশেষ শিক্ষা ও পেশাগত প্রশিক্ষণের মত পরিসেবা প্রদান করে থাকে এবং তাদের আনন্দমুখর উদ্যানে পরিণত হয়েছে ।
শাংহাইয়ের শহর ও গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন পাড়ায় ছড়িয়ে পড়া সূর্যালো পরিবারগুলোতে সর্বত্রই এমন আনন্দদায়ক ও আন্তরিক গান শুনতে পাওয়া যায় ।
বর্তমানে শাংহাইয়ে ৭০ হাজারেরও বেশি বুদ্ধির প্রতিবন্ধী রয়েছে । তাদের জ্ঞানার্জনের মান সীমিত এবং শ্রম করার দক্ষতাও নীচু রয়েছে । তাই বিশেষ শিক্ষা স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর তাদের চাকরী পাওয়ার সুযোগ খুব কম । তাদের অধিকাংশই কেবল বাড়িতে ফিরে বেকার হন এবং সমাজের সংগে যোগাযোগ ও বিনিময়ের অবকাশও তাদের সীমিত । আরো ভালোভাবে তাদের পরিসেবা প্রদানের জন্যে ২০০৫ সালে শাংহাই পৌর সরকার ক্রমেই শহর ও গ্রামাঞ্চলের পাড়ায় পাড়ায় সূর্যালো পরিবার গড়ে তুলেছে । এসব পরিবার লেখাপড়ার জন্যে বিনা খরচে বুদ্ধির প্রতিবন্ধীদের ভর্তি করে অথবা তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকে , যাতে তারা সহজে সমাজের সংগে মিশে যেতে পারেন । এ পযন্ত শাংহাই শহরে মোট ২ শ' চল্লিশটিরও বেশি সূর্যালো পরিবার গড়ে তোলা হয়েছে । এসব পরিবার ১১ হাজার ৫ শ' শিক্ষার্থীকে ভর্তি করেছে ।
সূর্যালো পরিবারের উদ্ভব বুদ্ধির প্রতিবন্ধীদের জন্যে আনন্দ এনে দিয়েছে । শাও লি লি হচ্ছেন একজন বুদ্ধির প্রতিবন্ধী মেয়ের মা । তিনি নিজেই গুরুতর অসুস্থ্য । তার স্বামী বেকার । অতীতে তিনি সারাদিন নিরব মেয়ের সামনাসামনে বসে থাকতেন । তখন তিনি জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণই হতাশ ছিলেন । অথচ তার মেয়ে সূর্যালো পরিবারে প্রবেশের পর প্রাণবন্ত হয়ে উঠে এবং নিজের আনন্দকে বাড়িতে নিয়ে আসে । ফলে অত্যন্ত অসুবিধায় পড়া এ বাড়ি আবারো সূর্যের আলোকে উদ্ভাসিত হয় । শাও লি লি বলেছেন ,
আমার মেয়ে একজন প্রতিবন্ধী হলেও মা হিসেবে আমি তাকে খুবই আদর করি । সে খুশী হলে আমার বাড়িতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে । সূর্যালো পরিবার আমার মেয়েকে সাহায্য করেছে । বস্তুত তারা আমাদের গোটা পরিবারকে বাঁচিয়ে তুলেছে । আমার জীবন আবার আশায় ভরপুর ও আলোকিত হয়েছে ।
বুদ্ধির প্রতিবন্ধীরা সূর্যালো পরিবারে জীবন ও শ্রমের দক্ষতা এবং সমাজের সংগে মেলামেশার সামর্থ্য সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ নেন , শারীরিক অনুশীলনে যোগ দেন এবং কিছু সহজ সরল শ্রম করেন । কিছু সময় প্রশিক্ষণ নেয়ার পর সাধারণত তাদের জীবনের স্বাবলম্বীতা এবং সমাজের সংগে তাদের মেলামেশার সামর্থ্য লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়ে যায় এবং তাদের জ্ঞানার্জনের মান ও শ্রমের দক্ষতাও বেড়ে যায় । তাদের অনেকে অতীতে সাসাদিন কথা বলতেন না । কিন্তু এখন তারা প্রাণবন্ত হয়ে উঠে । বাড়িতে ফিরে তারা সোত্সাহে আপনজনের সংগে গল্পগুজব করে । আরো কিছু প্রতিবন্ধী বাড়িতে ফিরে কাপড় ধোয়া ও ঘর সাফ করার মত কাজে বাবামাকে সাহায্য করে ।
বুদ্ধির প্রতিবন্ধী তরুণী লু সিয়ান পিং সূর্যালো পরিবারে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে লেখাপড়া করেছেন । তিনি বলেছেন ,
এখানে আমি অনেক আনন্দ পাই । কেন না , এখানে আমার অনেক বন্ধু আছে । এখানে শিক্ষকরা আমাদের নাচ শিখান । বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আমাদের ইংরেজী পড়ান ।
সূর্যালো পরিবারের শিক্ষকদের অধিকাংশই সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবক । তাদের অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী । প্রতিটি পরিবারে দশ বারোজন স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে । তারা প্রতিবন্ধীদের সংগে মিলে একত্রে শ্রম করেন ও ব্যায়াম করেন এবং তাদের শিক্ষিত করে তুলেন আর নাচগান শিখান । স্বেচ্ছায় প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করার প্রক্রিয়ায় তারা নিজেরাও আনন্দ লাভ করেন ।
শাংহাই ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিভাগে অধ্যয়ণরত নিং সু সিয়ান সূর্যালো পরিবারগুলোর দু হাজারেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবকের অন্যতম । সপ্তাহান্তে তিনি সবসময় সূর্যালো পরিবারে এসে ইংরেজী পড়ান । তিনি আমাদের সংবাদদাতাকে বলেন , অন্যকে সাহায্য করার পাশাপাশি আমি নিজেও অনেক সহায়তা পাই । কেন না , এসব প্রতিবন্ধীদের কাছ থেকেও আমি অনেক কিছু শিখেছি । তিনি বলেছেন ,
তারা তাড়াতাড়ি ইংরেজী শিখতে পারেন । একবার আমি তাদের ফলমূল সম্পর্কে কিছু ইংরেজী শব্দ শিখিয়েছি । তবে ক্লাসে তারা কয়েকটি প্রশ্ন করেছেন । আমাদেরও জানা নেই । বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে অভিদান দেখার পর আবার তাদের শিখাই । তারা খুবই সরলমনা ও চঞ্চল । যখন আমরা দেখতে পাই যে , তারা নিষ্ঠার সংগে কাজ করেন , তখন আমরা ভাবি যে , তারা পারলে , আমরা কেন পারবো না । আমাদের সামনে কোনো অসুবিধা দেখা দিলে আমরাও উদ্যোগের সংগে সামনে এগিয়ে যাবো ।
প্রতিবন্ধী তরুণী লু সিয়ান পিং এখন একদিকে সূর্যালো পরিবারে লেখাপড়া করেন , অপর দিকে সূর্যালো কারখানায়ও কাপড়ের পুতুল তৈরি করেন । এতে করে তিনি কিছু উপার্জন করেন । তিনি বলেছেন ,
একটি কাপড়ের পুতুল তৈরি করতে এক সপ্তাহ লাগে । এটি করতে অনেক পরিশ্রম করতে হয় । পুতুলটির দাম আনুমানিক এক শ' ইউয়ান হবে ।
শাংহাইয়ের সূর্যালো পরিবারের লক্ষ্য হচ্ছে যাতে বুদ্ধির প্রতিবন্ধীরা স্বাভাবিক লোকের মত জীবন যাপন করতে পারেন এবং চাকরী ও পরিবারের অধিকারী হতে পারেন , সেজন্যে প্রচেষ্টা চালানো । জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক এবং আন্তর্জাতিক বিশেষ অলিম্পিক কমিটির কর্মকর্তারা শাংহাইয়ের সূর্যালো পরিবার পরিদর্শন করেছেন । তারা স্বচোখে প্রতিবন্ধীদের তৈরি করা হস্তশিল্পজাত পণ্য , তাদের হস্তলিপি ও চিত্র দেখতে পেয়েছেন এবং তাদের শারীরিক অনুশীলনের দৃশ্যও দেখতে পেয়েছেন । চীন সরকার সমাজের সংগে মিশে যাওয়ার ব্যাপারে বুদ্ধির প্রতিবন্ধীদের যে সাহায্য করেছে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিশেষ অলিম্পিক কমিটির কর্মকর্তারা তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে । তারা বলেছেন , চীনের এ অভিজ্ঞতা বিশ্বে জনপ্রিয় করে তোলা উচিত ।
|