গত ৩০ বছর ধরে এক ভয়াবহ দৃশ্য সবসময় লিয়াওনিং প্রদেশের ইংখৌ শহরের লাওপিয়েন এলাকার আইন বিভাগের লি সিয়াওহোংকে ঘূম থেকে জাগিয়ে তুলে । স্বপ্নে যে দৃশ্য প্রায়ই দেখতে পান তা ৩০ বছর আগে সিয়াওহোং নিজেই অতিক্রম করেছিলেন । এই দৃশ্য ভোলাবার চেষ্টা করলেও সিয়াওহোং তা ভুলতে পারেন না বরং বারবার তা মনের পর্দায় ভেসে ওঠে ।স্বপ্নে ৩০-৪০ বছর বয়সী একজন পুরুষের অস্পষ্ট ছায়া প্রায় দেখানো হয় । এই ছায়া লি সিয়াওহোংয়ের মনের বীর-মূর্তি ।
৩০ বছর পর এই পুরুষের চেহারা সিয়াওহোংয়ের স্মৃতিতে অস্পষ্ট হয়ে গেছে । কিন্তু সিয়াওহোং বারবার স্বপ্নে এই চেহারা দেখেব্যাপার, ছবিটির অন্য অর্ধেকটা সে বছরের ভয়াবহ ভূমিকম্পে নষ্ট হয়ে যায় । ছবিটিতে দশ-বারোজন দশ-বারো বছর বয়সের মেয়ে ছিল ।
১৯৭৬ সালে লি সিয়াওহোং এবং ছবিটির অন্য দশ-বারোজন মেয়ে হোপেই প্রদেশের লুয়ান সিযেন জেলার এক মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রীছেন । নিজের জীবন যতই সুখী হয় সিয়াওহোংয়ের তাকে দেখার ইচ্ছা ততই প্রবল হয়ে ওঠে । তাকে খুজে বের করার জন্য সিয়াওহোং বহু লোকের সঙ্গে এবং সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন । অনেক প্রচেষ্টা করে চেহারা সম্পর্কিত যে একমাত্র প্রমাণ পাওয়া গেছে তা অর্ধেক ছবি ।
এটা ১৯৭৬ সালের ২৬ মার্চ তোলা একটা ছবি । ছবিটা লি সিয়াওহোংয়ের ১৫ বছর বয়সে তোলা একমাত্র ছবি । দুঃখের ছিল । সেই বছরের ২৭ জুলাই ক্লাসের ৪০জন ছাত্রছাত্রী থাংশান শহরের ডিজেল কারখানায় প্রশিক্ষণ নেয়। তারা থাংশান শহরের ৭নং মাধ্যমিক স্কুলের দুটো ক্লাসরুমে থাকে ।তাদের সঙ্গে ছিলেন শিক্ষক মা যিনি বারবার সিয়াওহোংয়ের স্বপ্নে দেখা দেন ।
১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই ভোরবেলা তিনটা ৪২ মিনিটের সময় লি সিয়াওহোং ও তার সহপাঠীরা ঘুমাচ্ছিল। হঠাত্ মাটি আলোড়িত হয় এবং সঙ্গেসঙ্গে বাড়িঘর সাংঘাতিকভাবে কেঁপে ওঠে । দরজা ও জানালার আওয়াজ হয় । ঘুম থেকে ওঠে ছাত্রছাত্রীরা ভয়ে চিত্কার করে ডাকতে থাকে । এমন একটি ভয়াবহ দৃশ্য লি সিয়াওহোং ও তার সহপাঠীরা অতিক্রম করেছিল ।এটাই ১৯৭৬ সালের থাংশান ভূমিকম্প । এই ৭.৮ রিখটার স্কেলের ভয়াবহ ভূমিকম্পে মোট ২ লাখ ৪০ হাজার লোক মারা যান , এক লাখ ৬০ হাজার লোক গুরুতরভাবে আহত হন এবং লাখ-কোটি বাড়িঘর ধসে পড়ে ।
আতঙ্কিত ও হতাশ দশ-বারো বছরের ছেলেমেয়েদের খতম করে দেয় । ঘরের ওপর থেকে পড়া ইট ও কাঠ একজন ছাত্রীকে মেরে ফেলে । সকল ছাত্রছাত্রী ঘরের মাঝখানে জড়ো হয়ে পরস্পরকে ধরে চিত্কার করে উঠে । ঠিক এই সময় শিক্ষক মা বাহির থেকে তাদের কাছে এলেন এবং বললেন, ভয় করো না , তাড়াতাড়ি আমার এ দিকে এসো । শিক্ষক মা'র কন্ঠস্বর অন্য সব আওয়াজ ঢেকে রাখে , এই কন্ঠস্বর অন্ধকারে আলোর মতো লি সিয়াওহোং ও তার সহপাঠীদের জন্য জীবনের পথ দেখালো । ছেলেমেয়েরা শিক্ষকের কন্ঠস্বর অনুসরণ করে শিক্ষকের কাছে জড়োহয় । শিক্ষক মা জোর করে একটার পর একটা ছেলেমেয়েকে ঘরের বাইরে ফেলে দেন । অবশেষ তিনি মরা ছাত্রীর লাশ বহন করে ক্লাস রুম থেকে বের হন । তার পা দুটো বের হওয়া মাত্র ক্লাসের বাড়িঘর তার পিছনে ধ্বসে পড়ে যায় ।
আতঙ্ক ও অসহায় তরণতরুণীরা আবার শিক্ষক মা'র কন্ঠস্বর শুনতে পেল । তিনি তার প্রতিটি ছাত্রের নাম ধরে ডাকলেনঃ লি সিয়াওহোং । লি সিয়াওহোং উত্তর দিল, আমি আছি । যে ছাত্রের নাম ডাকেন তিনি সেই ছাত্রকে স্পর্শ করে নিশ্চিত করেন । শিক্ষক মা তার ছাত্রছাত্রীদের উদ্ধার করেছেন এবং সাফল্যের সঙ্গে তাদের নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর করেছেন ।
৩০ বছর পার হয়ে গেছে । লি সিয়াওহো ও তার সহপাঠীরা বড় মানুষ হয়ে উঠেছে । এখন লি সিয়াওহোং লিয়াও নিং প্রদেশের ইংখৌ শহরের লাওপিয়েন এলাকার আইন বিভাগের একজন শ্রেষ্ঠ আইনজীবী । সময়ের সাথেসাথে ভূমিকম্পের ভয়াবহ ছায়া ধীরেধীরে স্মৃতি থেকে ম্লান হয়ে গেছে । কিন্তু শিক্ষক মা'র কথা সবসময় তার মনে পড়ে । শিক্ষক মাকে খুঁজে বের করার ইচ্ছা দিনদিন তীব্রতর হয়ে ওঠে ।
৩০ বছর বিচ্ছিন্ন হওয়া শিক্ষক মা'কে খোঁজার জন্য এ বছরের মে মাসে লি সিয়াওহোং বিশেষভাবে লিয়াওনিং প্রদেশের ইংখৌ শহর থেকে থাংশান শহরে আসেন । সেই অর্ধেক ছবি অনুসারে লি সিয়াওহোং হোপেই প্রদেশের লুয়ানসিয়েন জেলার দ্রব্য মূল্য ব্যুরোর প্রধান ক্য তিয়েনসিয়েন যিনি তখন লি সিয়াওহোংদের ক্লাসের মনিটার ছিলেন তাকে এবং অন্য কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে দেখা করেন ।
তারা সকলেই ভয়াবহ ভূমিকম্পের সময় শিক্ষক মা'র সঙ্গে জড়িত প্রতিটি বিষয়ের কথা স্মরণ করেন । যে কথা তারা কখনো ভূলতে পারেন না যে, যখন মাটি আলোড়িত হয় ,বাড়িঘর ধ্বসে পড়ে যায় , ভয়ে তারা চিত্কার করে ডাকে তখন শিক্ষক মা উচ্চস্বরে বলেন, যারা কমিউনিষ্টযুবলীগের সদস্য তারা দাঁড়িয়ে ওঠ ! শিক্ষক মা'র এই কথায় ছেলেমেয়েরা উত্সাহিত হল । তাদের আর ভয় লাগে না । সেই মুহুর্তে তারা দায়িত্বের তাত্পর্য বুঝল । এর পরের ৩০ বছরের মধ্যে লি সিয়াও হোং লিয়াওনিং প্রদেশের সরকারী কর্মচারীর দ্বিতীয় শ্রেণীর পুরস্কার পেয়েছেন । যখন ক্য তিয়েনসিয়েন লুয়ান সিয়েন জেলার দ্রব্যমূল্য ব্যুরোর পরিচালক নিযুক্ত হন তখন চাও রুইছিউ ২৭ বছর ধরে শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন । তারা সবসময় শিক্ষক মা'র সেই কথা মনে রাখেন । ক্য তিয়েনসিয়েন বলেন, শিক্ষক মা'র সেই কথা আমার সারা জীবনের উপর প্রভাব ফেলে । যাতে কিভাবে নিজেকে মানুষ করে তুলতে জানা যায় । লি সিয়াওহোং বলেন , শিক্ষক মা'র সেই কথা সবসময় আমার মনে থাকে । কাজের সময় আমি বারবার যুবলীগ সদস্যদের এই কথা বলি, যুবলীগ সদস্যের অর্থ কি ? প্রয়োজনীয় হলে দায়িত্ব পালনে তাদেরকে দাঁড়িয়ে উঠতে হবে । শিক্ষক মা'র প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আমি সবসময় প্রয়োজনীয়দের সাহায্য করি ।
লি সিয়াওহোংরা অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তারা কয়েকশ'বার ফোন করেছেন । অবশেষে তারা শিক্ষক মাকে খুঁজে বের করেছেন । শিক্ষক মা চিয়েনছুয়েন এখন পূর্ব খনি সংস্থার একটি মাধ্যমিক স্কুলে পড়াছেন । লি সিয়াওহোং ও তার সহপাঠীদের শিক্ষক মা'র সঙ্গে দেখা হল । লি সিয়াও হোংয়ের ৩০ বছরের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হল ।
|