মেয়ের স্কুল অভিভাবকদের কাছে এক আমন্ত্রণ চিঠি পাঠিয়েছে ।চিঠিতে মায়েদেরকে এক আলোচনা সভায় অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয় । আলোচনা সভায় ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মা সম্পর্কিত রচনা পড়ে শোনাবে । ছেলেমেয়েরা কিভাবে নিজেদের মার মূল্যায়ন করে তা শুনতে আমি খুবী আগ্রহী । তাই সেই সন্ধ্যায় আমি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আলোচনা সভায় উপস্থিত হয়েছি ।
একের পর এক ছেলেমেয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের লেখা পড়ে শোনায় । তাদের লেখা প্রায় এক রকম: মা আমার খুব যত্ন নেন, তিনি আমাকে হোম ওয়ার্ক লিখতে সাহায্য করেন । লেখার শেষ দিকে বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে প্রায় একই কথা লিখেছে যে, "এমন মা থাকায় আমি অত্যন্ত সুখী । " এ ধরণেরে কথা বেশি শুনায় আমার বিরক্তি হয় । অন্য অভিভাবকরাও বারবার হাতঘড়ির দিকে তাকাতে শুরু করেন ।
ঠিক এই সময় পঞ্চম শ্রেনীর এক মেয়ে মঞ্চে উঠে সবার প্রতি সালাম দেয় । তারপর সে নিজের প্রবন্ধ পড়তে শুরু করে । "আমার মা কখনো হাসেন না । তিনি আমার সব কিছু সম্পর্কে কখনো জিজ্ঞেস করেন না । আমি এক সপ্তাহে শুধু তাঁকে একবার দেখতে পাই । কিন্তু তিনি কখনো আমার নাম ডাকেন না বা আমাকে সম্ভাষণ করেন না ।"
মেয়েটির কথা শুনে নিচে বসে থাকা বাবামায়েরা অস্থির হন ।
"কারণ তিনি একজন চেতনাহীন মানুষ । আমার বয়স যখন ৫ বছর তখন মা এক গাড়ির দুর্ঘটনায়আহত হয়ে জ্ঞানহারানএবং তখন থেকে এ পর্যন্ত তিনি বিছানায় শুয়ে থাকেন। তিনি কখনো জেগে উঠেননি এবং আমার দিকে একবারও তাকাননি। আমি তাঁকে ডাকি ,কিন্তু তিনি উত্তর দিতে পারেন না । আমি তাঁর গালে চুমো দেই , তিনি হাসতে পারেন না । আমি জোর করে তাঁকে নিজের পরীক্ষার ফলাফল জানাই , তখন তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া জানান না । আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে , তিনি আমার সেই মা যিনি সবসময় আমার সঙ্গে খেলাধুলা করতেন এবং রাত্রে আমাকে কোলে নিয়ে গল্প শোনাতেন ।
নিচে বসা অভিভাবকদের মধ্যে অনেকের চোখ অশ্রু ভারাক্রন্ত হয়ে ওঠে ।
"কিছু দিন আগে এক টেলিভিশন খবরে আমি জেনেছি, যুক্তরাষ্ট্রের একজন অজ্ঞান মানুষের গায়ে লাগানো সব নল ব্যবস্থা ছাড়িয়ে নেয়া হয়েছে । আমি খুব ভয় করি ।আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করি,মা মরে যাবেন ? বাবা বলেন , না, তোমার মা মরবে না । আসলে তোমার মা জানে, আমরা তাকে ভালবাসি । সে সবই জানে ।"
" মা , আপনি জানেন, আমি এবং বাবা আপনার ফিরে আসার অপেক্ষা করছি ।"
উপস্থিত সকল বাবামায়েদের কান্না শুরু হয় ।
"বাবা, দয়া করে কালকে মাকে জানাবেন, আজ আমি এখানে উপস্থিত সকলের সামনে বলেছি , আমি তাঁকে ভালবাসি ।"
আমরা জলভরা দুটো চোখের মধ্য দিয়ে এক আসনে বসা একমাত্র সাহেবকে দেখেছি । লাল চোখে তিনি মৃদু হেসে উপস্থিত সকলের প্রতি সম্ভাষণ করেন । মঞ্চের নিচে হাততালির আওয়াজ জাগে ।
' "বোকা" বাবা'র' গল্প ।
নরম্যাল স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর আমি একটি প্রাথমিক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের চীনা ভাষা শেখাতে শুরু করি। প্রথম সপ্তাহের শেষ দিকে আমি ছাত্রছাত্রীদের জন্য "আমার বাবা" শিরোনামে এক রচনা লিখতে বলেছি । সোমবার আমি ছাত্রদের লেখা পড়েছি । কয়েকটা লেখা পড়ার পর আমি উপলব্ধি করেছি , এ কয়েকটা লেখা প্রায় এক রকম । এ সময় চিয়াং সিয়াওমিং নামে একটি ছেলের লেখা আমাকে আকর্ষন করে । তার লেখার শিরোনাম " আমার 'বোকা' বাবা"।
চিয়াং সিয়াওমিং লিখেছে , " আমার বাবা খুব বোকা । তিনি সবসময় এক কাজ করার সাথেসাথে অন্য কাজও করতেন । কিছু দিন আগে তিনি নোঙরা দেয়াল সাফ করার সময় চুল্লিতে পানি গরম করেন । কেটলির আওয়াজ শুনে তিনি তাড়াহুড়া করে চুল্লির দিকে ছুটে যান । তার অসাবধানে মেঝে রাখা রঙ উল্টা হয়ে পড়ে যায় । সাদা রঙ মেঝের উপরে ছড়িয়ে পড়ে । এর পর বাবা বারবার আমাকে বলেন , তুমি দেখ ,বাবা কত বোকা ।
প্রত্যেক দিন সকালে তিনি আমার জন্যে নাস্তা তৈরী করেন । একদিন তিনি আমাকে নাস্তা খাওয়ালেন এবং তাড়াহুড়া করে আমার ব্যাগ নিয়ে সাইকেল চালিয়ে আমাকে স্কুলে পাঠান । আমি মনে করি, বাবা আমাকে প্রশিক্ষণ কোর্সে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু সামনের চৌরাস্তায় পৌঁছুলে তিনি হঠাত আমাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন । তিনি মৃদুভাবে হাসতে হাসতে আমাকে বললেন , "তুমি দেখো, বাবা কত বোকা । আমি ভুলে গেছি আজ শনিবার , ছুটির দিন।"
এখানে পড়ে আমি হেসে উঠেছি । চিয়াং সিয়াওমিং সত্যি একটি দুষ্ট ছেলে । সে আরও লিখেছে, "আমার বাবা সত্যি বোকা । কিন্তু নানি বলেছেন , এ পর্যন্ত বাবা যে বোকামির কাজগুলো করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বোকামি হল , কয়েক বছর আগের এক রাতে , কারখানায় যাওয়ার পথে বাবা রেলপথের কাছে এক ছেলেকে উদ্ধার করেন । ছেলেটির আপন বাবা মা তাকে ছেড়ে দিয়েছে । আমি সেই ছেলে । আমার জন্যে ৩৬ বছর বয়সী বাবা এখনো বিয়ে করেননি ।নানি বলেছেন , যখন আমার বয়স তিন বছর তখন এক সুন্দরী মেয়ে তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলেন । কিন্তু তার পূর্ব শর্ত ছিল আমাকে অন্য কাউকে দিয়ে দেয়া । কিন্তু বাবা রাজী নন । তার পর বাবা আর বিয়ের কথা উল্লেখ করেননি ।
যদিও আমার বাবা খুব বোকা তবুও এই বিশ্বে তিনি আমাকে সবচেয়ে আদর করেন ।
অশ্রুতে আমার চোখদুটো ভরে যায় । কাল সন্ধায় আমি চিয়াং সিয়াওমিংয়ের সেই "বোকা" বাবাকে দেখতে যাব ।
|