চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিএকটানা অনেক বছর দ্রুত হয়েছে। এ বছরের প্রবৃদ্ধিও দ্রুত। ২০০৭ সালের প্রথম দু'মাসে চীনের শিল্প ও বৈদেশিক বাণিজ্য দ্রুতভাবে বেড়েছে। কিন্তু চীনের অর্থনীতির ক্ষেত্রে বহু সমস্যা ও মতভেদ দেখা দিয়েছে। সেজন্য চীন অব্যাহতভাবে বহুমূখী নিয়ন্ত্রণ জোরদার ও পুর্ণাংগ করবে। আজকের অনুষ্ঠানে আমি আপনাদের কাছে এ সম্বন্ধে কিছু বলবো।
১৮ মার্চ, চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৃতীয় বার সুদের হার বাড়িয়েছে। এর মাধ্যমে এক বছরে ব্যাংকের আমানতের সুদের হার শতকরা ০.২৭ ভাগ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এবারের সুদের হার বাড়ানো মুদ্রার ক্রেডিট ও পুঁজিবিনিয়োগ যথাযথভাবে বৃদ্ধি, মূল্যের স্থিতিশীলতার সুরক্ষা ও ব্যাংকিং সিস্টেমের স্থিতিশীল পরিচালনার ক্ষেত্রে কল্যাণকর হবে।
এ বছরের প্রথম দু'মাসে চীনের অর্থনীতির পরিসংখ্যান থেকে আমরা সহজভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোর ফল দেখতে পেয়েছি। চীনের ব্যাংকের ক্রেডিট দু'মাসের মধ্যে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ইউয়ান রেনমিনপি বেড়েছে এবং যা ইতিহাসের একই সময়ের সর্বোচ্চ হয়। যদি পুঁজিবিনিয়োগ অস্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রীত হয়, তবুও আবার বাড়ার চাপ রয়েছে।
চীনের পিপলস ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি ও ব্যাংকিং একাডেমির পরিচালক ছেন ইউলু সংবাদদাতাদের কাছে বলেছেন, এবারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানোর লক্ষ্য হল ক্রেডিট পুঁজির প্রসার নিয়ন্ত্রণ করা। তিনি বলেছেন,
'এবারের সুদের হার বাড়ানোর লক্ষ্য হল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। যদি পুঁজি এবং ঋণের ভাসমান অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে আবার সুদের হার বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে।'
মার্চ মাসে চীনের জাতীয় গণ কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন চিয়াপাও বলেছেন, বর্তমানে চীনের অর্থনীতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরো অনেক মতভেদ ও সমস্যা রয়েছে। প্রধান সমস্যা হল বস্তুগত পুঁজিবিনিয়োগের আকার ব্যাপক এবং ব্যাংকগুলোর পুঁজি অতি প্রচলিত। এর মাধ্যমে পুঁজিবিনিয়োগের দ্রুত বৃদ্ধি, বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক আয় এবং ভোগের সাম্যহীনতাসহ বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়।
ওয়েন চিয়াপাও বলেছেন, এ বছরে চীন বহু মুদ্রার নীতি দিয়ে যথাযথভাবে মুদ্রার ক্রেডিটের মোট পরিসংখ্যান নিয়ন্ত্রণ করবে। যাতে ব্যাংকগুলোর পুঁজির অতি প্রচলন নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাছাড়াও, চীন সরকার অব্যাহতভাবে কড়াকড়িভাবে ভূমি, ক্রেডিট ও বস্তুগত পুঁজিবিনিয়োগের আকার নিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তি, পরিবেশের সুরক্ষা ও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বাজারে প্রবেশের অনুমোদনের মানদন্ড বাস্তবায়ন করবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ বছর বস্তুগত পুঁজিবিনিয়োগের নিয়ন্ত্রণ ক্রমান্বয়ে বাড়বে। উত্পাদনের পরিমান বৃদ্ধির ফলে পুঁজিবিনিয়োগের গতি ধীর হবে। চীনের বহুমূখী অর্থনৈতিক সমিতির মহাসচিব ওয়াং চিয়ান বলেছেন,
'মুনাফা লাভ করতে পারার ক্ষেত্রে শিল্পপতিরা অবশ্যই পুঁজিবিনিয়োগ বাড়ান। কিন্তু উত্পাদনের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি হলে বাজারে পণ্যের প্রয়োজন কমবে। সেজন্য ভবিষ্যতে শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বর্তমানের চেয়ে কম হবে। আসলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আগের পুঁজিবিনিয়োগের পরিমান দ্রুত হওয়ায় শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর এ বছরে মুনাফা এবং তাদের পণ্যদ্রব্যের মূল্য কম হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের পুঁজিবিনিয়োগও কম হচ্ছে।'
এ কয়েক বছরে, পুঁজিবিনিয়োগের চেয়ে ভোগ কম। এটি হল চীনের অর্থনীতির উন্নয়নে একটি গুরুতর সমস্যা। প্রধানমন্ত্রী ওয়েন চিয়াপাও বলেছেন, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন বাড়াতে থাকা এবং বহু ব্যবস্থা নিয়ে শহর ও গ্রামের নাগরিকদের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। বিশেষ করে, গ্রামের বাণিজ্যিক প্রচলনও বাজারের ব্যবস্থা জোরদার এবং গ্রামের ভোগের পরিবেশ ও শর্ত পুর্ণাংগ করা উচিত। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০০৫ সালে গ্রামের ভোগ বাড়ানোর জন্য 'দশ হাজার গ্রাম এবং এক হাজার থানা' নামক পরিকল্পনা শুরু করে। এ বছর সারা দেশের শতকরা ৭৫ ভাগ জেলায় ২.৫ লাখ গ্রামীন দোকান খোলার সম্ভাবনা আছে। যাতে কৃষকরা নিজের ঘরের কাছাকাছি থেকে উত্কৃষ্ট পণ্যদ্রব্য কিনতে এবং সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন।
পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি একাডেমির পরিচালক লিউ ওয়ে মনে করেন, চীন সরকার সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণের ক্ষেত্রের ওপর গুরুত্ব দেবে। যাতে কম আয়ের নাগরিকদের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত করা এবং উচ্চ আয়ের নাগরিকদের সঙ্গেঁ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা যায়। তিনি বলেছেন,
'উচ্চ পর্যায় আয়ের নাগরিকদের আয় দ্রুত বাড়ায় প্রতীয়মান হচ্ছে যে, জিডিপি বাড়ার ফলে বেশির ভাগ তারা লাভ করে। যদি তাদের ভোগের পরিমাণ বেশি হয়, তবে তাদের আয়ের পরিমাণ আরো বেশি। আয়ের কম পরিমাণ তারা ভোগ করে। সেজন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের সৃষ্টি স্বার্থ যথেষ্ট ভোগে পরিণত হবে না।'
প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক আয় ও ভোগের সাম্যহীনতা হল চীনের অর্থনীতির উন্নয়নের আরেকটি গুরুতর সমস্যা। এটি শুধু যে চীনের প্রধান প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারীর সঙ্গে বাণিজ্যিক মতভেদ সৃষ্টি করে তাই নয়, বরং চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রচুর রেনমিনপি দিয়ে বৈদেশিক মুনাফা লাভ করে। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক-চীনের গণ ব্যাংকের মহাপরিচালক চৌ সিয়াওছুয়ান বলেছেন, আন্তর্জাতিক আয় ও ভোগের সাম্যহীনতা দূর করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল অর্থনৈতিক কাঠামোর পুনর্গঠন। তিনি বলেছেন,
'আন্তর্জাতিক আয় ও ভোগের সাম্যহীনতা দূর করতে সবচেয়ে বাস্তব পদ্ধতি হল অর্থনৈতিক কাঠামোর পুনর্গঠন। প্রথমে স্বদেশের প্রয়োজন বাড়ানো উচিত। বিশেষ করে ভোগের প্রয়োজন বাড়ানো, সেবা শিল্প উন্নয়ন করা ও আমদানি বাড়ানো উচিত। তাছাড়াও, চীনের শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশে পুঁজিবিনিয়োগ ও কারখানা নির্মাণ সমর্থন করা উচিত।'
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা ব্যুরোর অনুমান থেকে জানা গেছে, এ বছর চীনের রফতানির গতি কম হবে। রফতানির কাঠামো পুর্ণাংগ করা হবে। অনুমানে বলা হয় যে, যদি এ বছরে বিশ্বের অর্থনীতি বাড়ার গতি কম হয়, তবুও বেশি কম হবে না। চীনের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত হবে। এটি চীনের আমদানির দ্রুত বাড়ার ক্ষেত্রে কল্যাণকর হবে। চীনের শিল্প কাঠামোর পুর্ণাংগের ফলে সৃষ্টি রফতানিকৃত পণ্যদ্রব্যের প্রযুক্তির পর্যায় উন্নয়ন এবং অগ্রগতি প্রযুক্তি ও ইলেক্ট্রোনিক পণ্যদ্রব্যের রফতানি কর বাড়ানো রফতানির প্রতিদ্বন্দ্বিতার জোরদারের ক্ষেত্রে কল্যাণকর হবে। এর ফলে রফতানির কাঠামো আরো পুর্ণাংগ হবে।
আন্তর্জাতিক আয় ও ভোগে সাম্যহীনতার পাশাপাশি চীনের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ অব্যাহত বাড়ছে। বর্তমানে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধির ফলে চীনের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বজায় রাখা দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে কল্যাণকর। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ব্যাংকিং ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। চীনের অর্থমন্ত্রী চিন রেনছিং বলেছেন,
'চীন একটি রাষ্ট্রীয় পরিষদের নেতৃত্বে বৈদেশিক মুদ্রা পুঁজিবিনিয়োগ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করবে। বিশ্বের কোনো সফল অভিজ্ঞতা নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার পরিচালনা করবে। নিরাপত্তা সুরক্ষার ভিত্তিতে যথাসম্ভব বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থাপনা থেকে আরো বেশি স্বার্থ ও মুনাফা লাভ করা হবে।'
|