প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, আপনারা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শুনছেন, এখন সাপ্তাহিক বিশেষ অনুষ্ঠান "অর্থনীতির অগ্রযাত্রা", পরিবেশন করছি আমি ইলিয়াস খান।
প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, সাম্প্রতিক কয়েক বছরে, চীনের বিভিন্ন মহল শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক দায়িত্ব পালন করার বিষয়ের ওপর বেশি সজাগ দৃষ্টি রাখছে। ২০০৭ সালের প্রথম দিকে চীনের কোনো কিছু সরকারী ও বেসরকারী শিল্প-প্রতিষ্ঠান পৃথক পৃথকভাবে নিজেদের সামাজিক দায়িত্ব সংক্রান্ত বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তারা নিজেদের দায়িত্ব জোরদার এবং সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমি আপনাদের কাছে এ সম্বন্ধে কিছু বলবো।
শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়িত্ব হল শিল্প-প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করা এবং অংশীদারের স্বার্থ দেখার পাশাপাশি শ্রমিক, সম্প্রদায় ও পরিবেশ সুরস্যা করা। এরমধ্যে ব্যবসায়ে নৈতিকতা, উত্পাদনের নিরাপত্তা এবং শ্রমিকদের বৈধ স্বার্থ সুরক্ষা ও জ্বালানী সম্পদ সাশ্রয় করার বিষয় রয়েছে।
২১তম শতাব্দীর শুরু থেকে জাতিসংঘের প্রস্তাবে কোনো কোনো বিশ্ববিখ্যাত্ বহুজাতিক শিল্প-প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে থাকে। যেমন, ইন্টেল, নাইক, ওয়াল-মার্ট নিয়মিতভাবে নিজেদের সামাজিক দায়িত্ব সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০০৭ সালে শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়িত্ব সংক্রান্ত রিপোর্টের তালিকায় বহুজাতি শিল্প-প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি একটি চীনা শিল্প-প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। এটি হল চীনের জাতীয় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশন।
চীনের জাতীয় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশন বিশ্বের ৫শো সেরা শিল্প-প্রতিষ্ঠানের নাম তালিকায় রয়েছে। চীনের জাতীয় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশন ২৮ মার্চ প্রথমে 'শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়িত্ব সংক্রান্ত রিপোর্ট' প্রকাশ করেছে। চীনের জাতীয় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশনের একজন মূখপাত্র লি রুনশেং এ রিপোর্ট সম্বন্ধে বলেছেন,
'চীনের জাতীয় তেল কর্পোরেশন হিসেবে আমরা শুধু যে সমৃদ্ধ সৃষ্টি করব তাই নয়, বরং শিল্প-প্রতিষ্ঠানের অবিরাম উন্নয়ন বাস্তবায়ন এবং নিজের সাফল্য দিয়ে অংশীদার, শ্রমিক ও সামাজিক ফেরত দেয়া উচিত।'
এ রিপোর্টে চীনের জাতীয় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশনের ২০০৬ সালে জ্বালানী সরবরাহ, উত্পাদন আর পরিচালনা, শ্রমিকের উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণের কাজ বর্ণনা করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, গত বছর চীনের জাতীয় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশন ১৭.৫ বিলিয়ন ইউয়ান রেন মিনপি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর বৃহত্ পরিবেশ সংরক্ষণ এবং দুষিত জলের প্রতিরোধের পরিকল্পনায় ব্যবহার করে। চীনের জাতীয় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কোর্পরেশন ২০০০ সাল থেকে মোট ২.৫ বিলিয়ন রেনমিনপি সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। চীনের জাতীয় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, এখন থেকে প্রতি বছরে শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়িত্ব সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করবে। কর্পোরেশন আশা করে, এর মাধ্যমে প্রতিফলিত হবে যে নিজের ব্যবসায় অর্জিত স্বার্থ অর্থনীতি, পরিবেশ ও সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
২০০৫ সালে চীনের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশনের একটি শাখা রাসায়নিক শিল্প কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে প্রচুর বেন্জিন দুষণ উত্তর পূর্ব চীনের সংহুয়া নদীতে প্রবেশ করে এবং পানি গুরুতর দুষিত হয়। এ দূর্ঘটনার পর চীনের জাতীয় তেল ও প্রাকৃতিক কর্পোরেশনের গণ প্রতিমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এ কোর্পরেশন শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়িত্বের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখা শুরু করে। আগের শিল্প-প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব অগ্রাহ্য করা থেকে এখন নিয়মিতভাবে সামাজিক দায়িত্ব সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করবে, চীনের জাতীয় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশনের পরিবর্তনে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, চীনা শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমান্বয়ে সামাজিক দায়িত্বের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখছে এবং স্বীকার করছে।
এর আগে, বহু চীনের শিল্প-প্রতিষ্ঠান শুধু নিজেদের স্বার্থের ওপর গুরুত্ব দিত, কিন্তু সামাজিক দায়িত্বের ওপর গুরুত্ব দিত না। শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়িত্ব সংক্রান্ত একজন বিশেষজ্ঞ ও সোহু ওয়েবসাইটের অর্থনীতি সেলের প্রধান সম্পাদক ওয়াং চিহুই মনে করেন, দীর্ঘকাল ধরে চীনের বহু শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে ভূল ধারণা ছিল করে। তিনি বলেছেন,
'এসব শিল্প-প্রতিষ্ঠান মনে করে, তাঁদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল স্বার্থ লাভ ও মুনাফা করা। এটিই হল শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়িত্ব।'
পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, চীন বেশির ভাগ শিল্প-প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের বৈধ স্বার্থ সংরক্ষণে সমস্যা রয়েছে। কিছু শিল্প-প্রতিষ্ঠানে জ্বালানী সম্পদ আপচয়, পরিবেশ দুষণ, জাল পণ্যদ্রব্য উত্পাদন এবং বিক্রী ও মেধাসত্ব নিয়ে সমস্যা আছে। এসব ব্যাপার শুধু যে শিল্প-প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সম্পর্কিত নাগরিক ও ভোক্তা ব্যক্তিদের জন্য গুরুতর ক্ষতিকর তাই নয়, বরং এসব শিল্প-প্রতিষ্ঠানের নিজেদের অর্থনৈতিক ও গণ ভাবসূতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চীনের কিছু কিছু শিল্প-প্রতিষ্ঠান সামাজিক দায়িত্ব পালন না করার কারণ অনেক। এর মধ্যে প্রধান কারণ হল শিল্প-প্রতিষ্ঠানের নিজেদের স্বার্থ ছাড়াও সামাজিক দায়িত্ব পালন করার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের বর্তা ব্যক্তিদের অগ্রাহ্য করা। তারা সাধারণত মনে করেন, সামাজিক দায়িত্বের ওপর বেশি সজাগ দৃষ্টি রাখলে, নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বতার কমবে।
এ মনোভাব সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সামাজিক দায়িত্ব পালন করলে, ক্ষণস্থয়ী শিল্প-প্রতিষ্ঠানের উত্পাদন ব্যয় বাড়বে। কিন্তু এর মাধ্যমে আরো কম ব্যয় ও মূল্যে জ্বালানী সম্পদ পাওয়া নেবে এবং এসব জ্বালানী সম্পদ নিজের জ্বালানী সম্পদের সঙ্গে বণ্টন করবে। যাতে আরো বিপুল প্রতিদ্বন্দ্বতা গড়ে তোলা যায়। চীনের পিপলস ইউনিভারসিটির একজন অর্থনীতিবিদ্ব ডক্টর লি ইফিং বলেছেন,
'যে সব শিল্প-প্রতিষ্ঠান প্রথমে সামাজিক দায়িত্ব পালন করে, সেসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ভাবমূর্তি গড়ে উঠবে এবং সমাজ থেকে তার প্রতদান পাবে।'
শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে অনেক বিষয় রয়েছে। যেমন, ভোক্তা, শ্রমিক, অংশীদার, জনকল্যাণ ও পরিবেশ। সোহু ওয়েবসাইটের অর্থনীতি সেলের প্রধান সম্পাদক ওয়াং চিহুই বলেছেন, এখন চীনের শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত প্রধানত ভোক্তাদের উত্কুষ্ট পণ্যদ্রব্য ও সেবা সরবরাহ করা। তিনি বলেছেন,
'শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়িত্ব হল শিল্প-প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সাংম্পর্কিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব। ভোক্তা হল শিল্প-প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন স্বার্থ ব্যক্তি। যদি শিল্প-প্রতিষ্ঠান ভোক্তার সঙ্গে সম্পর্ক অগ্রাহ্য করে, তাহলে শিল্প-প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ধ্বংস হবে। ভোক্তা হল শিল্প-প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের প্রধান নিয়ম।'
১৫ মার্চ হল চীনের ভোক্তাদের স্বার্থ দিবস। চীনের ভোক্তা সমিতি কর্মসূচী আয়োজন করে সত্যনিষ্ঠ এবং আইন অনুযায়ী ব্যবসা ও ইতিবাচকভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালন করার প্রস্তাব করেছে। চীনের বহু শিল্প-প্রতিষ্ঠান ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে এবং পৃথক পৃথকভাবে ঘোষণা করেছে যে, তারা সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে ইচ্ছুক।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আরো বেশি চীনের উত্কৃষ্ট শিল্প-প্রতিষ্ঠান সামাজিক দায়িত্ব পালনে অংশ নিচ্ছে। এটি হল শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মনোভাবের সংস্কার। পাশাপাশি এতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, চীনের শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যদ্রব্যের গুণ, পরিবেশ ও সম্প্রদায়ের দায়িত্বসহ সার্বিক দায়িত্বের প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করবে।
প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, এতোক্ষণ আপনারা অর্থনীতির অগ্রযাত্রা নামক সাপ্তাহিক বিশেষ অনুষ্ঠানটি শুনলেন। আপনারা ভাল থাকুন, সুস্থ্য থাকুন। আশা করি, আপনারা আগামী সপ্তাহে আবার এ সময়ে আমাদের অনুষ্ঠানটি শুনবেন। আবার কথা হবে।
|