চীনের হোনান প্রদেশের রাজধানী চাংচৌ শহরে অবস্থিত হোনান জাদুঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই আপনারা চীনের প্রাচীন সংগীত শুনতে পাবেন। চীনের প্রাচীনকালের সংগীত পরিবেশক দলের শিল্পীরা এই সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে দেশি-বিদেশী অতিথিদের আগমনকে স্বাগত জানাতেন।
হোনান প্রদেশে জাতীয় পর্যায়ের পুরার্কীতি সংরক্ষণ ইউনিটই রয়েছে ৯৬টি। হোনান জাদুঘর হচ্ছে চীনের তিনটি বৃহত্তম জাদুঘরের একটি। এই জাদুঘরে ১৩ লাখ পুরার্কীতি রয়েছে। এই সংখ্যা চীনের জাতীয় পর্যায়ের সকল জাদুঘরের সংরক্ষিত পুরার্কীতির মোট সংখ্যার প্রায় আট ভাগের এক ভাগ।
হোনান জাদুঘর হচ্ছে ইতিহাস ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের একটি বিশাল জাদুঘর। এই জাদুঘরের আয়তন ১ লাখেরও বেশি বর্গমিটার । ১৯৯৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত হওয়ার পর প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখানে আসেন।
জাদুঘরে সংরক্ষিত জিনিসগুলো ঐতিহাসিকমানসম্পন্ন হলেও জাদুঘর ভবনটি কিন্তু সত্যি সত্যিই আধুনিক এবং খুব সুন্দর। তখন আমাদের বেতারের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মহিউদ্দিন তাহের সাহেবও ছিলেন। আমরা সবাই জাদুঘরটি দেখে অবাক হয়েছি। এর প্রকতি, এর গঠন, এর অবস্থান ও নির্মাণ কৌশল এবং এর ভিতরের পুরাকীর্তি যা আমাদের ক্ষণিক সময়ের জন্যে হলেও আবেগে আপ্লুত করেছিল।
হাড় দিয়ে তৈরি বাঁশি
এই জাদুঘরে অনেক রকম প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র দেখা যায়। তা দেখে, চীনের প্রাচীন সংগীতের যে অতি উচ্চ মান ছিল তা সহজেই ধারণা করা যায়। যেমন , পাখির হাড় দিয়ে তৈরি বাঁশি হচ্ছে এখন পর্যন্ত চীনে আবিষ্কৃত সবচেয়ে প্রাচীন বাঁশি। চীনের প্রাচীন সংগীত পরিবেশক দলের পরিচালক ম্যাডাম ওয়াং সুয়েন সংবাদদাতাকে বলেছেন, "৮০০০ বছর আগের তৈরি হাড়ের বাঁশি দিয়ে সাতটি সুর বাজানো যায়।" কি আশ্চর্য ? আধুনিককালের সঙ্গে তার কি অপূর্ব মিল ।
বিয়েনচুং
বন্ধুরা, এই সুযোগে আমি আপনাদের আরেকটি চীনের প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রের পরিচয় দেবো। এর নাম হচ্ছে বিয়েনচুং। বিয়েনচুং হচ্ছে প্রাচীন সংগীত দলের সবচেয়ে বড় বাদ্যযন্ত্রের সেট। বিয়েনচুং এর ইতিহাস ২৫০০ বছরের বেশি। এক সেট বিয়েনচুংয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ২৬টি ছোট ছোট বিয়েনচুং। চীনের প্রাচীন রাজ পরিবারের বিশেষ বাদ্যযন্ত্র হিসেবে বিয়েনচুংয়ের নির্মাণ কৌশল নির্ভুল ও সুক্ষ এবং এর সুরের বিস্তৃতি হৃদয় ছুয়েঁ যায়।
চীনের প্রাচীন সংগীত পরিবেশক দলের বাজানো প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রগুলোর ইতিহাস ২৩০০ বছর থেকে ৮০০০ বছর পর্যন্ত। কল্পনা করা যায়, কয়েক হাজার বছর আগের লোকেরা কি সুললিত ও মন ভোলানো সুর শুনতেন। কিন্তু এখন এই বাদ্যযন্ত্র বাজানো সত্যিকার অর্থেই সহজ কাজ নয়। চীনের প্রাচীন সংগীত পরিবেশক দলের কর্মী ম্যাডাম চাং ঈ "ছিং" নামে এক রকম প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র বাজান। তিনি বলেছেন, "ছিং বাজানোর একটি কৌশল হচ্ছে হাতের আঙ্গুল দিয়ে ছিংয়ের ওপর চাপ দেয়ার জায়গা ও ওজনের মাত্রা। কারণ কেবল সঠিক জায়গায় চাপ দিলে শব্দ বের হয়। এবং যুক্তিযুক্ত ওজন প্রয়োগ করলেই কেবল সুললিত সুর শুনা যায়।"
চীনের প্রাচীন সংগীত দলের শিল্পীরা পরিবেশনার সময় প্রাচীন লোকের মতই পোষাক পড়ে বাদ্যযন্ত্র বাজান। প্রত্ন উপাত্ত অনুসারেই তাঁরা পোষাক পড়েন এবং বাদ্যযন্ত্র প্রদর্শন ও পরিবেশনা করেন। তা দেখে পর্যটক দর্শকরা যেন অতীতের ভেতর হারিয়ে যায়। জানেন না যে, এ সময় নিজেই হয়তো কোন রাজবংশের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
হোনান জাদুঘরের গবেষক ম্যাডাম লি হোং সংবাদদাতাকে বলেছেন, চীনের প্রাচীন সংগীত পরিবেশক দলের মাধ্যমে চীনের প্রাচীন সংগীত পুনরুদ্ধার হয়েছে। এটা হচ্ছে প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র প্রদর্শনের একটি বিশেষ ধরণের উপায়। তিনি বলেছেন, "যুব শিল্পীরা প্রাচীনকালের কাপড়-চোপর পড়ে প্রাচীন সংগীত বাজালে ঐতিহাসিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এবং বর্তমানকালের লোকজন তখন ঐতিহাসিক এক মোহনীয় পরিবেশের মধ্য দিয়ে হারিয়ে যেতে পারেন কল্পলোকে।"
কয়েক হাজার বছর আগের সংগীত পুনঃপ্রচারের জন্য হোনান জাদুঘর বিশ ধরনেরও বেশি প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রের অবিকল যন্ত্র পুনঃনির্মাণ করেছে এবং ২০০০ সালে প্রাচীন সংগীত পরিবেশক দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা বিশেষ করে চীনের প্রাচীন সংগীতের সুরগুলো বাজান। এখন পর্যন্ত এ সংগীত দল প্রায় ২০০টি প্রাচীন যন্ত্র সংগীত সফলভাবে পরিবেশন করেছে। কিছু কিছু প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ যেন আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের মতই। সুর ও সংগীতের ওপর ধারণা না থাকলে সহজে পার্থক্য বোঝা যাবে না।
হোনান জাদুঘরের প্রাচীন সংগীত কেবল দেশি-বিদেশি সাধারণ পর্যটকদেরই আকৃষ্ট করেছে তাই নয়, বরং দক্ষিণ কোরিয়া, তান্জানিয়া ও থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দগণও এর ভূয়সী প্রসংশা করেছেন। চীনের তাইওয়ান থেকে আসা ম্যাডাম উ হোং সংবাদদাতাকে বলেছেন, "আজ আমি এই জাদুঘরে এতো বেশি পুরার্কীতি দেখেছি তা বলে বুঝাতে পারবো না। বিয়েনচুং এর মর্মষ্পর্শী সুললিত সুর শুনে আমি খুবই খুশি এবং অভিভূত।"
প্রত্যেকবারের সংগীতানুষ্ঠানের পর প্রাচীন সংগীত পরিবেশক দলের শিল্পীরা পর্যটকদের মঞ্চে এসে তাদের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর আমন্ত্রণ জানান। এবার ফ্রান্স থেকে আসা কয়েকজন পর্যটক মিলিতভাবে তাদের দেশের একটি লোকসংগীত বাজিয়েছেন। চীনের প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র দিয়ে চীনের শিল্পী ও বিদেশী বন্ধুদের সহযোগিতায় আধুনিক সংগীত বাজানো সত্যিই এক নতুন অভিজ্ঞতা । তা শুনতেও খুব ভালো লাগে। যেন নতুন জীবনের আবাহন।
বলা যায়, হোনান জাদুঘর দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে চীনা জাতির ইতিহাস প্রদর্শনের পাশাপাশি চীনা জাতির প্রাচীন সংগীতের মাধ্যমে বিশ্ব জনগণের কাছে চীনের বিশেষ মোহময়-শক্তিকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।
হোনান জাদুঘরের টিকিটের দাম মাত্র ২০ ইউয়ান রেনমিনপি। প্রতি দিন সকাল দশটায় ও বিকাল ৩টায় দু'বার পর্যটকদের জন্য সৌজন্য হিসেবে জাদুঘর সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যসহ এর পরিচিতি দেয়া হয়। প্রাচীন সংগীতের অনুষ্ঠান রোজ দু'বার অনুষ্ঠিত হয়। উত্সবের দিনে বা কোন বিশেষ কর্মসূচি আয়োজনের সময় এই জাদুঘরে পর্যটকদের ভিড় খুব বেশী থাকে। সুতরাং আপনি যদি বিস্তারিতভাবে চীনের ইতিহাস অনুভব করতে চান, তাহলে কাজের দিনে সেখানে গেলেই সবচেয়ে ভালো।
|