প্রফেসর রাইহান হাসিম এক হাজারেরও বেশি স্কুলচ্যুত ছেলেমেয়েকে আবার স্কুলে ফেরত পাঠিয়েছেন বলে ছেলেমেয়েরা তাকে ভালবাসার মা বলে আখ্যায়িত করে ।
রাইহান হাসিম সিনচিয়াং তেল ইনষ্টিটিউটের একজন এসোসিয়েট প্রফেসর ছিলেন । অবসর নেয়ার পর তিনি শান্তিতে তার বার্ধক্যের জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু এক আকস্মিক ঘটনায় তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, দারিদ্রের কারণে কিছু ছেলেমেয়ে স্কুলে ভর্তি হতে পারে না , এমনকি কিছু ছেলেমেয়ে বিভ্রান্তের পথে চলে যায় । ১৯৯৫ সালের এক দিন , রাইহান হাসিম বাজারে সবজি কিনতে যাচ্ছিলেন। ঠিক এই সময় তিনি যেন দু-একটি কমবয়সী ছেলের কান্না শুনতে পেলেন। তিনি কান্নার আওয়াজ অনুসরণ করে খুঁজতে শুরু করেন এবং দেখতে পেলেন যে, কয়েক লোক দুটি ছেলেকে বকাবকি করছিল। রাইহান সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পেলেন , ছেলে দুটো চুরি করেছে । তিনি লোকদের বকাবকি থামিয়ে দেন এবং ছেলে দুটোকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন ।
রাইহান ছেলেদুটোকে পরিস্কার কাপড়চোপড় পরালেন এবং সুস্বাদু খাবার খাওয়ালেন । রাইহান ধৈর্য্যের সঙ্গে বিস্তারিতভাবে তাদের সবকিছু জেনে নিলেন । দুই ছেলে বলেছে, দরিদ্রের কারণে তাদেরকে স্কুলচ্যুত হতে হয় এবং দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা মেটানোর জন্য তাদেরকে চুরি করতে হয় । ব্যাপারটা রাইহানকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে । তিনি বলেছেন , সেই রাতে আমার ভাল ঘুম হয়নি । মা হিসেবে আমার নিজের বাচ্চারা বড় হয়েছে । কিন্তু আজকের কথা ভেবে আমার খুব দুঃখ লাগে । এই দুটো ছেলেকে আর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে দেয়া হবে না । তাদেরকে পড়াশুনা করতে দেয়া হবে । আমি ভেবেছি ,এখন সমাজে অনেক ছেলেমেয়ে দরিদ্রের কারণে স্কুলচ্যুত হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় । তারা চুরি করে বা এখানে ওখানে বিরক্তির সৃষ্টি করে । তাদের স্নেহ , ভালবাসা ও মায়ের উষ্ণতার অভাব । আমি একটি মা, তাদেরকে মায়ের উষ্ণতা দেয়া আমার দায়িত্ব ।
অনেক চিন্তাভাবনার পর রাইহান একটি সিদ্ধান্ত নিলেন , তিনি দুটো ছেলেকে নিজের বাড়িতে থাকতে দেবেন এবং নিজেই তাদেরকে পড়াবেন । আনন্দের ব্যাপার হল এই যে, দুটি ছেলে তাড়াতাড়ি নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়েছে । তারা এখন পড়াশুনা করতে অত্যন্ত আগ্রহী হয়েছে । রাইহান ও দুটি ছেলের গল্প তাড়াতাড়ি চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে । আশেপাশে লোকেরা পরপর তার কাছে অনেক স্কুলচ্যুত ছেলেমেয়েকে পাঠান । ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তিনি ২৭জন ছেলেমেয়েকে বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন শুধু তাই নয়,তিনি তাদের খাওয়াদাওয়া ও স্কুলফি দিয়েছেন এবং অবশেষে তাদেরকে আবার স্কুলে ফিরতে সাহায্য করেছেন । তাঁর স্নেহ ও শিক্ষা লাভ করে এই সব ছেলেমেয়েরা নিজেদের খারাপ অভ্যাস ছেড়ে দিয়ে পড়াশুনাপ্রিয় ভাল সন্তানে পরিণত হয়েছে । তাদের অগ্রগতি দেখে রাইহান অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছেন ।
তিনি বলেছেন, আমি একজন মা, আমার এই ভালবাসা প্রতিটি ছেলেমেয়েকে দিতে চাই । আমি একজন শিক্ষকও । শিক্ষকের দায়িত্ব হল ছাত্রদের বিদ্যা দান করা এবং নানা দিক থেকে তাদের শিক্ষাদান করা । অভিভাবকরা নিশ্চিন্তে নিজেদের সন্তানকে আমার হাতে দিয়েছেন । তাই আমাকে ভালভাবে শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে হবে । তাদের যত্ন নিতে এবং ভালবাসতে হবে ।
রাইহানের আচরণ তাঁর কাছের প্রতিটি লোকের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে । তার সহপাঠী ,তার বন্ধু সবাই তাকে সমর্থন করেন । কোনো কোনো লোক তার মতোই গরিব ছেলেমেয়েদেরকে আর্থিক সাহায্য করেন । ভালবাসার মায়ের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে যায় । রাইহানের বন্ধু, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জাইতুনাম এদের মধ্যে একজন । তিনি বলেছেন, অসুবিধাপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু কাজ করতে কেউই অস্বীকার করবে না । আমি অবসরপ্রাপ্ত । বাড়িতে তেমন বেশী কোন কাজ নেই। তাই ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করতে পারলে আমি খুব খুশি হই । এখন অধিক থেকে অধিকতর লোক আমাদের এই দলে যোগ দিয়েছেন ।
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এক হাজারেরও বেশি দরিদ্র ছেলেমেয়ে রাইহানদের আর্থিক সাহায্য পেয়েছে ।
নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রী, উইগুরজাতির উজারনুরের বাবা অনেক আগে মারা যান । তার মা'র কাজ নেই বলে তারা খুব কষ্টের মধ্যে দিন কাটায় । তাই উজারনুর ও তার দুই বোনের স্কুল ফি দেয়া মায়ের কাছে এক কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় । রাইহানরা উজারনুরের অবস্থা জেনে তাড়াতাড়ি তাদের জন্য স্কুলফি ও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠান । এ সম্পর্কে উজারনুর বলেছে, রাইহান মা'দের আর্থিক সাহায্য না থাকলে আমাদের আজকের সব কিছু হত না । আমি তাদের প্রতি খুব কৃতজ্ঞ । আমি ভালভাবে পড়াশুনা করে তাদের প্রতিদান দেব ।
হুইজাতির ছাত্রী মা ইয়েন ভালবাসার মা'দের আর্থিক সাহায্যও পেয়েছিল । সে বলেছে, তাদের সাহায্য ছাড়া আমি আজ স্কুলে পড়াশুনা করতে পারতাম না । তারা অত্যন্ত স্নেহ ও মায়ামমতাপূর্ণ । তারা আমার মার মতোই । আমি ভালভাবে লেখাপড়া করব এবং তাদের মতো অন্যান্যকে সাহায্য করব ।
স্কুলচ্যুত ছাত্রছাত্রী ছাড়া রাইহান ও তার বন্ধুরা অনেক অসুস্থ ছেলেমেয়েকেও সাহায্য করেছেন ।এক অসমাপ্ত পরিসংখ্যানে জানা গেছে, রাইহানরা পরপর ১৮জন গুরুতর রোগে আক্রান্ত ছেলেমেয়েকে সাহায্য করেছেন । তাদের ভালবাসাপূর্ণ কাজ গোটা সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । ২০০৫ সালে সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের দাতব্য সমিতির সমর্থনে " ভালবাসার মা তহবিল" প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের ব্যক্তিরা ৩ লাখ রেনমিনপি জমা দিয়েছেন ।
রাইহান বলেছেন , আমার বয়স ৬৮ বছর । আমি বয়স্ক হয়েছি । কিন্তু আমি আমাদের এই ভালবাসার কাজ অব্যাহতভাবে চালাতে থাকব ।আমি আরও বেশি যুব মানুষকে এই কাজে অংশ নিতে উত্সাহ দেব । আমি যতদিন জীবিত থাকব ততদিনই পর্যন্ত এই কাজ চালিয়ে থাকব ।
|