৪৯১ সালে সিউয়ান খোং মন্দির নির্মিত হয় । এর ইতিহাস ১৫০০ বছরেরও বেশি । সিউয়ান খোং মন্দির হুনইউয়ান জেলার একটি উপত্যকায় অবস্থিত । উপত্যকার দুই দিকে পাহাড়ের উচ্চতা ১০০মিটারেরও বেশি,মন্দিরটি পাহাড়ের মাঝখানে খাড়া ঢালে অবস্থিত,মাটির উপরে প্রায় ৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত । গোটা মন্দিরটি খাড়া ঢালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে । মন্দিরটি পাহাড়ের খাড়া ঢালে নির্মাণের ফলে সারা বছর বৃষ্টি ও সূর্য্যের আলো থেকে বঞ্চিত। এ কারণেই হাজার বছর পরও তা ভালভাবে খাড়ার ঢালে ঝুলে থাকতে সক্ষম হয়েছে ।
সিউয়ান খোং মন্দির প্রধানত কারুকার্য খচিত মূল্যবান কাঠের দ্বারা মজবুতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে । মন্দিরের আয়তন ১৫২.৫ বর্গমিটার, যা একটি বাস্কেটবল কোর্টের অর্ধেকের চেয়েও ছোট । মন্দিরে মোট ৪০টি ঘর আছে । মন্দিরটির চার দিক ঘীরে আরো অনেক কাঠের তৈরী নানা ধরনের হল ও ছোট ছোট ঘর রয়েছে । মন্দিরের উপর পাথরগুলো ঠিক আকাশের দিকে উঠার জন্য প্রস্তুত বলে মনে হয় ।
সিউয়ান খোং মন্দির ভ্রমণ করা চীনা ও বিদেশী পর্যটকরা এ স্থাপত্যের বিশেষ নির্মাণ পদ্ধতি দেখে খুবই আশ্চর্য্য হয়ে যায় । মন্দিরের বিভিন্ন তলার মধ্যে কাঠ দিয়ে তৈরী সিঁড়ি সংযুক্ত রয়েছে । সিঁড়িগুলো সরাসরিভাবে খাড়ার ঢালে নির্মিত হয় । তা খুবই সঙ্কীর্ণ, শুধু একজন মানুষ হেঁটে যেতে সক্ষম । পর্যটকরা সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় উত্তেজনার পাশাপাশি রোমাঞ্চও অনুভব করেন এবং খুব আস্তে ও সাবধানে কাঠের সিঁড়িতে হাঁটেন । তাঁরা মনে করেন, যদি দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠেন , তাহলে গোটা মন্দির খাড়ার ঢাল থেকে হয়তো পড়ে যাবে । পর্যটক লিন ইউ ছোট এই পথে সংকীর্ণ হাঁটার সময় উত্তেজনাময়ভাবে বলেছেন, এ মন্দির খুবই উঁচ্চু, আমার মনে হয় আমি আকাশে ঝুলে আছি ।"
হুনইউয়ান জেলায় সিউয়ানখোং মন্দির সম্পর্কে একটি জনপ্রিয় কথা হল "সিউয়ানখোং মন্দির , আকাশের অর্ধেক উচ্চতায় অবস্থিত। তিনটি "ঘোড়ার লেজ" আকাশের মাঝখানে তাকে ঝুলিয়ে রেখেছে ।" এ কথায় "ঘোড়ার লেজ" মানে মন্দিরের নিচে ঋজুভাবে রাখা কাঠের স্তম্ভ । ৩০টি কাঠের স্তম্ভ উপরের মন্দিরটাকে ধরে রেখেছে । কাঠের নীচে পাহাড়ের পাথরের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে । অধিকাংশ পর্যটক মনে করেন, এসব ঋজু কাঠের স্তম্ভ সিউয়ানখোং মন্দিরকে তুলে ধরেছে । কিন্তু মন্দিরের কাঠামো নিয়ে গবেষণা করা বিশেষজ্ঞ সুন ই এ মতামতকে মানেন না। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, আসলে সকল ঋজু কাঠের স্তম্ভ মন্দিরের কোনো ওজন বহন করে না । মন্দিরের সম্পূর্ণ ওজন পাথরের ভিতরে প্রথিত দিগন্তস্থিত কাঠের স্তম্ভ বহন করছে । তা হল সিউয়ানখোং মন্দিরের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বৈচিত্র্য ।
দিগন্তস্থিত কাঠের স্তম্ভ হল সিউয়ানখোং মন্দিরের নিচে পাহাড়ের ভিতরে অবস্থিত সমাস্তরালভাবে রাখা কাঠ । অনেক দূর থেকে দেখলে সকল কাঠের স্তম্ভকে মনে হবে যেন পাহাড়ের ভিতর থেকে তা বেড়িয়ে এসেছে । মন্দিরে মোট ২৭টি সমাস্তরাল কাঠের স্তম্ভ রয়েছে । গোটা মন্দিরের নিম্নাংশ সকল সমাস্তরাল কাঠের স্তম্ভের উপর রাখা । বিশেষজ্ঞ সুন ই বলেছেন, এসব কাঠের স্তম্ভের ওজন বহনকারী জায়গা প্রাচীনকালের স্থাপত্য শিল্পীর সঠিক হিসাবের ভিত্তিতেই নির্মিত হয়েছে । এদের মধ্যে কয়েকটি কাঠের স্তম্ভ ওজন বহন করে , কয়েকটি কাঠের স্তম্ভ মন্দিরের উচ্চ ও নিম্নাংশের মধ্যে সমন্বয়ের ভুমিকা পালন করে ।
যদি শুধু সমাস্তরাল কাঠের স্তম্ভ মন্দিরের ওজন বহন করে ,তাহলে কেন মন্দিরের নীচে অনেকগুলো ঋজু করা কাঠের স্তম্ভ ঝুলে রয়েছে ? এ সম্পর্কে স্থানীয় অধিবাসীরা একটি কাহিনী বলেছে ।জানা গেছে, সিউয়ানখোং মন্দির নির্মাণের শুরুতেই মন্দিরের নীচে কাঠের স্তম্ভ খুব মজবুত করে তৈরী করা হয় ।অনেক দূর থেকে দেখলে গোটা মন্দিরটি খুব সুন্দর লাগে না এবং আকাশের মাঝখানে ঝুলিয়ে রাখার দৃশ্যও অনুভব করা যায় না । এ জন্য মন্দির নির্মাণ করা একজন পুরনো সন্ন্যাসী ঋজু করা কাঠগুলো সরিয়ে নিয়েছেন । কিন্তু ঋজু করা কাঠ সরিয়ে নেয়ার পর পর্যটকরা মন্দির পড়ে যেতে পারে এই ভরে উপরে উঠতে চায় না । ফলে সন্ন্যাসীগণ পুনরায় স্লিম কাঠের স্তম্ভ দিয়ে মন্দিরটিকে নীচ থেকে ঠেস দিয়ে রেখেছেন । এসব ঋজু করা কাঠ শুধু সাজানোর জন্যই রাখা হয়েছে ।
এটা শুধু প্রাচীনকালের একটি কাহিনী । কিন্তু বর্তমান চীনের বিখ্যাত স্থাপত্য বিশেষজ্ঞ ২০ বছরের বেশি গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, সিউয়ান খোং মন্দিরের নীচে কাঠের স্তম্ভ তুলে ধরার কোনো ভূমিকা পালন করছে না । এ মন্দিরের বিশেষ স্থাপত্য ডিজাইন হল পাখির বাসা নির্মাণের পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কিত । তিনি বলেছেন, পাহাড়ের আকার খুবই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, স্থাপত্য শিল্পীরা পাহাড়ের আকার অনুযায়ী কাঠ দিয়ে মন্দিরটি নির্মাণ করেছেন, ফলে গোটা মন্দিরটি দেখতে অতি সুন্দর ও আশ্চর্য্যজনক মনে হয় ।
সিউয়ানখোং মন্দিরের সবচেয়ে বিশেষ বৈচিত্র হল এর সূক্ষ্মকারু কাজ । তা মন্দির নির্মাণ করার সময় থেকেই ভৌগলিক অবস্থা অনুযায়ী বিশেষ ডিজাইনের মাধ্যমে একে প্রতিফলিত করা হয়েছে । যেমন মন্দিরের সবচেয়ে বড় হলের অন্যতম হল সানকুয়ান হল । হলের সামনেই কাঠ দিয়ে তৈরী ঘর, এর পিছনে পাথরের ওপর অনেক গুহা তৈরী করা হয় ।ফলে এর স্থাপত্য কর্ম অনুযায়ী গোটা মন্দিরের জায়গা বিস্তৃত হয়েছে ।
যদিও মন্দিরের বাইরের দিকটা দেখতে ছোট ও সুক্ষ্ম, তবুও এর ভিতরে অনেক ভাষ্কর্য্য রয়েছে । যেমন লৌহ দিয়ে তৈরী ভাষ্কর্য্য, মাটি ও পাথর দিয়ে তৈরী খোদাই ভাষ্কর্য্য । এসব ভাষ্কর্য্য সূক্ষ্মভাবে তৈরী করার জন্য এর শিল্প মূল্য খুবই দামী । স্থাপত্যের বিশেষ ডিজাইন ছাড়া সিউয়ানখোং মন্দির হল চীনের একমাত্র ত্রি ধর্মের সম্মিলনের মন্দির । তিনটি ধর্ম হল বৌদ্ধ ধর্ম, তাও ধর্ম ও কনফুসিয়াস ধর্ম । সিউয়ানখোং মন্দিরের সবচেয়ে উঁচু ঘর সানচিয়াও হলে শাক্যমুনি,লাউজি এবং কনফুসিয়াসের মুর্তি সম্মিলিতভাবে সাজানো রয়েছে ।
এ সম্পর্কে সিউয়াংখোং মন্দির প্রশাসনিক কার্যালয়ের প্রথম পরিচালক চাং চিয়ান ইয়াং বলেছেন, বিদেশী ও চীনের পর্যটকরা মন্দির ভ্রমণ করার সময় এখানকার বিশেষ দৃশ্য দেখতে পারেন । শুধু চীনের সিউয়ানখোং মন্দিরেই তিনটি ধর্মের ধর্মীয় নেতা একসাথে রয়েছে । তা হল নানা ধর্মের সুষম অবস্থানের নিদর্শন ।
টিকিটের দাম ৬০ ইউয়ান এবং তাথোং রেল স্টেশন থেকে বাস যোগে সিউয়ানখোং মন্দিরে যেতে হয় ।বাস ভাড়া ১৫ ইউয়ান । প্রতি বছরের বসন্ত ও গ্রীষ্মকাল হচ্ছে পর্যটনের সবচেয়ে ভালো সময় । মনে রাখবেন প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত মন্দিরটি খোলা থাকে । তাথোং শহরের শীতকাল খুবই ঠাণ্ডা এবং গ্রীষ্মকাল খুবই আরামদায়ক ।
|