চীনের শান সি প্রদেশের ইয়ুন ছেং শহরের ইয়ান হু এলাকার ছাও ইয়ুন গ্রামে পল্লী চিকিত্সক ওয়াং লিয়ান চুই গ্রামবাসীদের মধ্যে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছেন । সবাই তাকে গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্য রক্ষাকারী দেবী বলে অভিহিত করে থাকেন । চিকিত্সক ওয়াংয়ের চিকিত্সার নীতি হলো : ওষুধ দিয়ে রোগীদের আরোগ্য করতে পারলে তিনি তাদের ইঞ্জেকশন দেন না । ইঞ্জেকশন দিলে রোগীদের আরোগ্য করতে পারলে তিনি তাদের স্যালাইন পুশ করেন না । তাই এ গ্রামের লোকেরা বলেন , আমাদের গ্রামে চিকিত্সা নিলে কোনো অসুবিধা থাকবে না এবং চিকিত্সা ফিও বেশি লাগবে না ।
ছিয়াও ইয়ুন গ্রামের ক্লিনিক আকারে ছোট হলেও সব ধরণের চিকিত্সা সুবিধা এখানে রয়েছে । চিকিত্সা কক্ষ পরিষ্কার ও গুছানো রয়েছে । এ ক্লিনিকে ইঞ্জেকশনকক্ষ , ওষুধাগার , পরিবার পরিকল্পনা পরিসেবা প্রদান কক্ষ এবং নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষা কক্ষ সবই রয়েছে । কোনো কোনো গ্রামবাসী আমাদের সংবাদদাতাকে বলেছেন , যখন ওয়াং লিয়ান চুই প্রথমে এখানে আসেন , তখন কিন্তু এমন অবস্থা ছিল না ।
১৯৭৯ সালে যখন ওয়াং লিয়ান চুই ছিয়াও ইয়ুন গ্রামে আসেন , তখন এ গ্রামের ক্লিনিকে কেবল হৃত্পিন্ডের স্পন্দন শোনার মেশিন ও রক্তচাপ মাপার মেশিন ছিল । এমন অবস্থা দেখে ওয়াং লিয়ান চুই অত্যন্ত অবাক হয়ে যান এবং মনে মনে শপথ নেন যে, তিনি এ ক্লিনিকের উন্নয়ন ঘটাবেন এবং নানা ধরণের রোগ প্রতিরোধ করে গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করবেন ।
টাকা উপার্জনের জন্যে তিনি ও তার স্বামী চিকিত্সা করার পাশাপাশি মুরগী পালনের কাজ শুরু করেন । এতে করে তিনি বেশ কিছু টাকা উপার্জন করতে সক্ষম হন । তখন অনেকে তাকে ক্লিনিকের কাজ ছেড়ে শুধু মুরগী পালনের কাজ করার পরামর্শ দেন । অথচ ওয়াং লিয়ান চুই নানা উপায়ে তার স্বামীকে বুঝিয়ে মুরগী পালন থেকে পাওয়া যাবতীয় আয় ক্লিনিকটির নির্মাণ কাজে ব্যবহার করেন । তিনি এক বছর একটি ঘর নির্মাণ করে এবং একটি চিকিত্সা সরঞ্জাম বসিয়ে ক্রমেই ক্লিনিকটি সম্পূর্ণ করে তুলেছেন ।
তখন থেকেই ছিয়াও ইয়ুন গ্রামের লোকেরা নিজেদের বাড়ির পাশেই সুচিকিত্সা পেতে শুরু করেছেন এবং জরুরী রোগে আক্রান্ত হলেও সময়মত চিকিত্সা নিতে পারছেন ।
ওয়াং লিয়ান চুই সবসময় বলে থাকেন যে , একজন চিকিত্সক হিসেবে প্রথমে ভালো মানুষ হতে হবে , তারপর ভালো চিকিত্সা দিতে হবে । ভালো মানুষ হওয়ার অর্থ হলো: জনসাধারণের প্রতি সদিচ্ছা থাকতে হবে । তাঁর সুদক্ষ চিকিত্সা পদ্ধতির তুলনায় ওয়াং লিয়ান চুইয়ের উন্নত চিকিত্সা নৈতিকতা আরো প্রশংসনীয় ।
একদিন বিকেলে ওয়াং লিয়ান চুই পর পর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত একজন শিশু ও অন্য একজন গুরুতর রোগীর চিকিত্সা করার পর সন্ধ্যার খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন , তখন আরেকজন গুরুতর রোগী তার ক্লিনিকে আসলেন । তিন ঘন্টারও বেশি সময়ের চিকিত্সার পর রোগী বিপদমুক্ত হলেন । ততক্ষণে ওয়াং লিয়াং চুই অতি ক্লান্ত হয়ে রোগী শয্যার পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন ।
রোগীদের ভিন্ন অবস্থা অনুসারে ওয়াং লিয়ান চুই চিকিত্সা ফি কমানো, মওকুফ করা বা দেরীতে দেয়ার নিয়ম প্রণয়ন করেছেন । যেসব লোকের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয় , সেসব লোকের চিকিত্সা ফির ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমিয়ে আনা হয় । চিকিত্সা নেয়ার সময় টাকার অভাব দেখা দিলে গ্রামবাসীদের প্রথমে চিকিত্সা নেয়া হয় এবং ওষুধ দেয়া হয় । পরে চিকিত্সা নেয়ার সময় টাকা শোধ করা যায় । যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয় , তারা বিনা পয়সায় এ ক্লিনিকে চিকিত্সা নিতে পারেন । গ্রামবাসী ওয়াং কেন ছাইয়ের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ । গত দশ বারো বছরে ওয়াং লিয়ান চুই প্রতি বছর তার ৩ হাজারেরও বেশি ইউয়ান চিকিত্সা ফি মওকুফ করে থাকেন ।
গ্রামবাসী ওয়াং ইন ছেং অসুস্থ্য হয়ে পড়লে প্রথমে শহরে ভর্তি হয়েছিলেন । বাড়িতে ফেরার পর তার চিকিত্সা অব্যাহত রাখতে হলো । সেই সময় ঠিক বর্ষাকল চলছিল । তার সুবিধার্থে ওয়াং লিয়ান চুই একটানা ১৬ দিন ধরে তার বাড়িতে গিয়ে তার চিকিত্সা করলেন এবং এর জন্যে তিনি একটি পয়সাও তার কাছ থেকে নেন নি ।
তিনি বলেছেন , রোগীদের আস্থা অর্জনের জন্যে উন্নত চিকিত্সা পদ্ধতি এবং জনসাধারণের প্রতি ভালোবাসা থাকা প্রয়োজন । গত ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন । বহু বছর ধরে তিনি এ নীতি অনুসারে কাজ করেছেন । যাতে জনসাধারণ কম খরচে তার ক্লিনিকে চিকিত্সা নিতে পারেন , সেজন্যেই তিনি নানা উপায় গ্রহণ করেছেন ।
ওয়াং লিয়ান চুই গণ স্বাস্থ্য সম্পর্কে সবসময় সচেতন এবং দায়িত্ববান রয়েছেন । তিনি ছিয়াও ইয়ুন গ্রামের ক্লিনিকে কাজ করার পর সারা গ্রামে কোনোদিন ভয়াবহ সংক্রামক রোগের প্রচলন হয় নি ।
গত কয়েক বছরে ওয়াং লিয়ান চুই প্রতি মাসের ১০ তারিখকে গ্রামের প্রাথমিক টিকা নেয়া দিবস হিসেবে ধার্য্য করেছেন । তার গ্রামের শিশুদের সুপরিকল্পিত টিকা নেয়ার হার সবসময় ৯৮ শতাংশেরও বেশি । তাছাড়া তিনি সারা গ্রামের ২৩ শ'রও বেশি লোকের বিনাপয়সায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন এবং পারিবারিক ভিত্তিতে স্বাস্থ্যগত দলিলপত্র স্থাপন করেন । স্থানীয় গ্রামবাসীরা বলেছেন , ছোটখাটো অসুখ হলে তাদের আর বাইরে যেতে হবে না এবং গুরুতর অসুখ হলেও তাদের আর দুশ্চিন্তার আশংকা থাকবে না ।
ওয়াং লিয়ান চুইয়ের স্বামী একজন শিক্ষক ছিলেন । পরে তিনি দেখতে পেয়েছেন , ক্লিনিকের কাজ খুব বেশি । তাই তিনিও ক্লিনিকে তার স্ত্রীকে সাহায্য করতে নিযুক্ত হন । এভাবে তিনি এ ক্লিনিকে বিশ বছর ধরে কাজ করেছেন । আজ ওয়াং লিয়ান চুইয়ের দুই মেয়েও তার পরামর্শ অনুসারে শহর থেকে তার গ্রামে ফিরে এ ক্লিনিকে কাজ করছেন ।
|