মি: লি সিং হাওয়ের বয়স পঞ্চাশ বছর , তিনি চীনের বৃহততম বেসরকারী এয়ার কন্ডিশনার প্রস্তুত কারখানা--কুয়াংতোং প্রদেশের জি গাও এয়ার কন্ডিশনার কোম্পানির পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান । ২০০৪ সালে একটার পর একটা সুসংবাদ লি সিং হাওয়ের কানে এসেছে । । এই বছরে তাঁর কোম্পানির এয়ার কন্ডিশনার বিক্রির পরিমান শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বেড়েছে । এই জন্য তিনি চীনের সংস্কার অভিযানে নতুন কীর্তি স্থাপনকারী দশ জন শিল্পপতির অন্যতম নির্বাচিত হয়েছেন । বিখ্যাত মার্কিন বাণিজ্য সাময়িকী ফোর্বেস চীনের মুল ভুভাগের যে ধনী শিল্পপতিদের নির্বাচন করেছে তাঁদের কাতারেও তিনি স্থান পেয়েছেন ।
লি সিং হাওয়ের বাড়ি কুয়াংতং প্রদেশের ফু সান শহরের উপকন্ঠের ফেংকাং গ্রামে । দক্ষিণ চীনের খ্যাতনামা বন্দর কুয়াংচৌ থেকে প্রায় একঘন্টার পথ । সেখানে কৃষি জমি আর দেখা যায় না । গ্রামবাসীর বাড়িঘর , দোকানপাট ও কলকারখানা দেখে মনে হয় ,একটি ছোটো শহর সেখানে গড়ে উঠেছে ।
ফেংকাং গ্রামে লি সিং হাওয়ের ফিকে লাল রংয়ের চার তলা বাড়ি বড় করে চোখে পড়বার নয় । এক তলায় তুলার সুতোর দস্তানা তৈরীর একটি কর্মশালা যা খোলা হয়েছে দশ বছর আগে। একতলার উপরে থাকেন লি সিং হাওয়ের পরিবার পরিজন । তাঁদের বৈঠকখানা অতি সাধারন ।আসবাব পত্র সবই কাঠের । বসারঘরের কোনে একটি পুরনো সেলাইকল ।
লি সিং হাওয়ের দুই মেয়ে । একজন নিউজিল্যান্ডে পড়াশোনা করছেন , অন্য জন পড়ছেন শহরের একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে । তাঁর আশি বছর বয়সের মা তাঁদের সংগে থাকেন । লি সিং হাও ও তাঁর স্ত্রী প্রতিদিন কোম্পানির ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত । পরিবারের সবাইয়ের মিলনের সময় তেমন বেশী নেই ।মাঝে মাঝে বাড়িতে শুধু তাঁর মা ও আয়া থাকেন ।
লি সিং হাওয়ের মা সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , তাঁর জীবন বৈচিত্র্যময় , টিভি অনুষ্ঠান দেখা ছাড়া তিনি ঘরদোর পরিস্কার করার মত গার্হস্থ্যকাজও করেন । তাঁর হাত এখনো সক্রিয় , পোশাক তৈরী করা তাঁর শখ । তাঁর গায়ে আস্তিনবিহীন জ্যাকেট তাঁর নিজের তৈরী ।পাতলা তাঁর শরীর , তবে তাঁকে বেশ সতেজ মনে হয় । দ্রুত ও পরিস্কার ভাবে কথা বলেন তিনি ।
তিনি বলেছেন ,আমার ছেলে ভোর ছ'টা বাজতে না বাজতে বাড়ি থেকে বের হয় , ও ভারি ব্যস্ত , দিনে বাড়িতে ফিরে আসার জো ওর নেই । কোনো কোনো সপ্তাহে শুধু দু তিন বার রাতে ফিরে আসে ।
লি সিং হাও রোজ অসম্ভব ব্যস্ত । তিনি লম্বা নন, কিন্তু মুক্তমনা , সবার সংগে প্রাণ খুলে কথা বলেন । একটি কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম । তাঁর বাবা অনেক বছর আগে মারা যান । মা একা কয়েকটি সন্তান মানুষ করেছেন । তখন তাঁরা অভাব অনটনের মধ্যে দিন কাটাতেন ।কাজেই উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ না করেই তাঁকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে ।
পরিবারের ভরণ-পোষণে মাকে সাহায্য করার জন্য লি সিং হাওকে দোকান খুলে ব্যবসা করতে হয়েছিল । দশ বছর আগে তিনি তাঁর জন্মস্থানে একটি এয়ার কোন্ডিশনার মেরামতের কারখানা স্থাপন করেন । দশ বছর ব্যাপি কঠোর প্রচেষ্টায় এই ছোটো কারখানা এয়ার কোন্ডিশনার, ইলেক্ট্রোনিক পন্য , রাসায়নিক দ্রব্য , জীব বিদ্যা প্রযুক্তি ক্ষেত্রের সংগে সম্পৃক্ত একটি বৃহত আধুনিক শিল্প গোষ্ঠীতে রুপান্তরিত হয়েছে । তার বিক্রির জাল ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের ২০০টিরও বেশী দেশ ও অঞ্চলে ।
লি সিং হাওয়ের জন্মস্থান রয়েছে কুয়াং তং প্রদেশে । চীনের যে কয়েকটি প্রদেশে বেসরকারী অর্থনীতির উন্নয়নের গতি সবচেয়ে দ্রুত কুয়াং তং প্রদেশ তাদের অন্যতম ।গত শতাব্দীর নববইয়ের দশকের প্রথম দিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও যৌথ মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠনের পাশাপাশিই বহু ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কলকারখানা স্থাপিত হয় । লি সিং হাওয়ের মতে গত দশ বছরে তাঁর কোম্পানি যে এত দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হয়েছে তার মূলে কাজ করেছে স্থানীয় সরকারের বলিষ্ঠ সমর্থন ।
তিনি বলেছেন ,আমাদের স্থানীয় সরকারের কর্মচারীরা কর্মনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল , আমাদের শিল্প গোষ্ঠি শেয়ার বাজারে নিন্ধিত হবে শুনে স্থানীয় সরকারের অর্থ বিভাগের কর্মীরা আমার বাড়িতে এসে জিজ্ঞাস করেছেন ,তাঁরা আমাদের জন্য কি করতে পারেন । স্থানীয় সরকার অসুবিধা কাটিযে ওঠতে যে আমাদের সাহায্য করেছে তা আমাদের কারখানার উন্নয়নপথ সুগম করেছে ।
বর্তমানে জি গাও শিল্প গোষ্ঠী বিশ্বের অনেক আন্ত:র্দেশীয় শিল্প গোষ্ঠীর সংগে সহযোগিতা চালাচ্ছে । জি গাও শিল্প গোষ্ঠীর ব্যবসা প্রসারের সংগে সংগে লি সিং হাও মাঝে মাঝে চিন্তা করেন ,তিনি গ্রামবাসীর জন্য কি করতে পারেন । তিনি অনেক গ্রামবাসীকে তাঁর কারখানায় কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন । তাঁর গ্রামের পঞ্চান্ন বছরোর্ধ বৃদ্ধবৃদ্ধা প্রতিমাসে তাঁর কাছ থেকে ভাতা পান । তিনি নিজের টাকা দিয়ে গ্রামবাসীদের জন্য বাস্কেটবলের মাঠ , স্যুইমিংপুল ,পার্ক ও বৃদ্ধবৃদ্ধাদের মঙ্গল কেন্দ্র নির্মান করেছেন ।
লি সিং হাওয়ের কৃতার্থতার মুলে রয়েছে তাঁর স্ত্রী চৌ ওয়ান লিংয়ের অকুন্ঠ সমর্থন । স্বল্প ভাষী মাদাম চৌ একজন সরল ও দৃঢ়চিত্তা নারী । যখন স্বামী জীবন সংগ্রাম করছিলেন তখন তিনি নিরবে ঘরকনা করা ছাড়া ব্যবসা করার সুযোগের সন্ধান করতেন ।এখন স্বামী সফল হয়েছেন , কিন্তু তিনি বাড়িতে বিলাসী জীবন যাপন করতে নারাজী । আগের মত তিনি মোটর সাইকেলে চড়ে রোজ অফিসে যান ।
লি সিং হাওয়ের ছোটো মেয়ে একটি স্থানীয় বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখছেন । বড় মেয়ে লি সিউ হে বাবামায়ের আর্থিক সাহায্যে নিউজিল্যান্ডে অধ্যয়ন করছেন । গত সেপ্টেম্বর মাসে ছুটি কাটানোর জন্য দেশে ফিরে জন্মস্থানের পরিবর্তন দেখে তিনি অবাক হলেন ।
তিনি বলেছেন , আমাদের গ্রাম আরো সুন্দর হয়েছে ।বাবার অফিস এখন নতুন ভবনে । কারখানার নতুন কর্মশালাও নির্মান করা হচ্ছে । সব কিছুই বদলে গেছে , আমার বাড়িও চিনার উপায় নেই ।
লি সিং হাওয়ের বাসনা, তাঁর দুটো মেয়ে যতদুর সম্ভব জ্ঞান অর্জন করবেন ।তাঁদের শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভাবী মালিক গড়ে তোলার ইচ্ছা তাঁর নেই ।তাঁর মতে শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভার কার হাতে ন্যস্ত হবে ,সেটা বড় কথা নয় , বড় কথা হলো , শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সামর্থ্য ভাবী মালিকের থাকতে হবে । আমি যাকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে কর্মঠ বলে মনে করি তাঁর হাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভার ন্যস্ত করতে দ্বিধাবোধ করব না । কারণ , জি গাও শিল্প গোষ্ঠির প্রতি আমার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে ।
|