চীনের উত্তর-পূর্বাংশের মঙ্গোলিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আর রাশিয়া ও মঙ্গোলিয়ার সীমান্ত অঞ্চলের সঙ্গে সংলগ্ন একটি ছোট্ট নগর আছে , এর নাম মানচৌরিয়া । শহরটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর। মানচৌরিয়া চীনের শহর হলেও কিছুটা রুশ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।
মানচৌরিয়ার রাস্তায় প্রায়শঃ হলুদ রং চুল ও সবুজ রং চোখের রুশ ব্যক্তিদের দেখা যায়। বিভিন্ন ধরনের ছোট দোকানের সাইনবোর্ডে চীনা ভাষা ছাড়াও রুশ ভাষা ও মঙ্গোলিয়ান ভাষায় লেখা রয়েছে। সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, বিদেশে আছি। মানচৌরিয়ার একটি তারকা হোটেলে কর্মরত মিস. সিন মেই জানিয়েছেন, "এখন মানচৌরিয়ায় আসা রুশ ব্যক্তিদের সংখ্যা অনেক বেশি। বিশেষ করে শীতকালে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি রুশ ব্যক্তিরা এখানে আসেন। কারণ ডিসেম্বর মাসে বড় দিন পালিত হয়। তাঁরা বড় দিনের উপহারগুলো কেনার জন্য এখানে আসেন। যেমন কিছু কাপড়-চোপড়, টুপি, জুতাসহ আরো অনেক কিছু। কারণ চীনের বাজারে এ সব পণ্য পাওয়া যায়।"
মানচৌরিয়ার মাতরুশকা মানে পুতুল মহাচত্বরও যেন পর্যটকদের আবশ্যিক পর্যটন স্থানে পরিণত হয়েছে। রাশিয়ার পুতুল হচ্ছে এক ধরনের বিশেষ খেলনা। এর নাম মাতরুশকা। বড় পুতুলের ভিতরে দশ বারটি ছোট ছোট পুতুল থাকে। একটি চেয়ে আরেকটি ছোট । এ ভাবে ভেতরে সাজানো থাকে। মাতরুশকা মহাচত্বর হচ্ছে চীনের একমাত্র রাশিয়ার ঐতিহ্যিক মাতরুশকা নিয়ে গঠিত পর্যটন ও বিনোদন মহাচত্বর । এ মহাচত্বরের আয়তন ৬০ হাজার বর্গমিটার। এর প্রধান স্থাপত্য হচ্ছে ৩০ মিটার উচু একটি বড় মাতরুশকা । এটা হচ্ছে বর্তমানে পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মাতরুশকা । এর চার পাশে আরো ২০০টি ছোট ছোট পুতুল ও ঈষ্টার উত্সবের জন্যে তৈরি ৩০টি রঙিন ডিমের খোসা ছড়িয়ে আছে। তা মধ্য দিয়ে মৈত্রী, ভালোবাসা ও শুভ কামনার কথা প্রতিফলিত হচ্ছে। মহাচত্বরের সংগীত ঝর্নার পাশে চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব ১২টি বার্ষিক প্রতীক ও ১২টি রাশিচক্র দাঁড়িয়ে আছে। পর্যটকরা ক্লান্ত হলে মাতরুশকার ভিতরে রেস্তোরায় গিয়ে খাবার খেতে পারেন অথবা অনুষ্ঠান হলে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারেন।
শীতকালে মানচৌরিয়ার সব দিকে বরফ পরে সাদা হয়ে যায়। রাতে রুমের বাইরের তাপমাত্রা শুন্যের নিচে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হয়ে যায়। কিন্তু অতি শীত আবহাওয়া সত্বেও লোকজনের এখানে এসে পর্যটনের আগ্রহ মোটেই কমে নি। বরফ পর্যটন মানচৌরিয়ার একটি বিশিষ্ট্য হয়েছে। প্রতি বছরের শীতকালে মানচৌরিয়ায় বরফ উত্সব অনুষ্ঠিত হয়। চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের শিল্পীরা বরফ ও তুষার দিয়ে বিভিন্ন রকম বরফ ও তুষার ভাস্কর্য তৈরি করেন। তাঁরা বরফ ও তুষার দিয়ে চীনের ইতিহাসে নাম করা ব্যক্তিগণ আর অন্যান্য দেশের বিখ্যাত স্থাপত্যগুলো খোদাই করেন। বরফ দিয়ে তৈরি গড়ানো খেলার যন্ত্র বাচ্চাদের পছন্দনীয় খেলনা হয়েছে। মানচৌরিয়ায় বড় হওয়া প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র লি তুং শাং বলেছেন, "শীতকালীন বরফ উত্সব চলাকালে এখানে খুব মজা। কেউ কেউ গান গায়। কেউ কেউ নৃত্য করে। নানা ধরনের স্থাপত্য দেখা যায়। বিশেষ করে বরফ খেলার যন্ত্র খেলতে খুব মজা। চীনা, মঙ্গোলিয়ান ও অন্য দেশের লোকেরা সবাই এখানে এসে খেলেন ও ছবি তুলেন।"
বরফ উত্সবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ। তখন রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া ও চীনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পর্যটকরা মানচৌরিয়ায় আসেন। সেখানে চমত্কার বরফ ভাস্কর্য ও তুষার ভাস্কর্য দেখা যায়। এ ছাড়াও পর্যটকরা চীন , রাশিয়া ও মঙ্গোলিয়া এই তিনটি দেশের শিল্পীদের পরিবেশিত অনুষ্ঠানগুলো দেখতে পারেন। চীনা শিল্পীদের নৃত্য, মঙ্গোলিয়ান শিল্পীদের ফ্যাশন শো ও রাশিয়ার বিশিষ্ট নৃত্য হচ্ছে প্রতি বছরের নিয়মিত অনুষ্ঠান। রুশ মেয়ে ন্যাস্তিয়া বিশেষ করে বরফ উত্সবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখার জন্য মানচৌরিয়ায় এসেছেন। তিনি বলেছেন, "আমি তুষার ভাস্কর্য ও এখানকার অনুষ্ঠানগুলো দেখতে পছন্দ করি। চমত্কার। বরফ উত্সবে অংশগ্রহণকারী রুশ ব্যক্তির সংখ্যা অধিক থেকে অধিকতর হয়েছে। এখানকার বরফ উত্সব রাশিয়াকেও প্রভাবিত করেছে।"
মানচৌরিয়ার রুশ বৈশিষ্ট্য ও বরফ উত্সবের উষ্ণ পরিবেশ অনুভব করার পর মানচৌরিয়া ত্যাগ করার আগে আপনি উপহার হিসেবে কিছু ছোট ছোট পণ্য কিনতে ভুলবেন না কিন্তু। রাশিয়ার পর্যটকরা মানচৌরিয়াকে খুব ভালোভাবে জানেন। মানচৌরিয়ার রাস্তায় প্রায়ই দেখা যায় যে, হাতে বড় ও ছোট ছোট ব্যাগ নিয়ে হাঁটাহাঁটি করা রুশ ব্যক্তির সংখ্যা অনেক।
চীন ও রাশিয়া যৌথভাবে প্রতিষ্ঠিত মানচৌরিয়ার চীন-রাশিয়া পারস্পরিক বাণিজ্যিক অঞ্চল হচ্ছে রাশিয়ার লোকদের চীনা পণ্য কেনার ভালো জায়গা। এ বাণিজ্যিক অঞ্চল ঠিক মানচৌরিয়া ও রাশিয়ার সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত। সেখানকার পণ্যদ্রব্যের রকমারিতা অপেক্ষাকৃত বেশি। এমন কি , পর্যটকরা সেখানে খুব সস্তা দামে সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের উত্পাদিত পণ্যও কিনতে পারেন। তা ছাড়া, মানচৌরিয়া শহরে আরো অনেক বাজার রয়েছে। সে সব বাজারগুলোতে পর্যটকরা রাশিয়া ও মঙ্গোলিয়া থেকে আসা অনেক ছোট ছোট পণ্য কিনতে পারেন। যেমন রাশিয়ার উত্পাদিত পুতুল, অলঙ্কার বক্স, রৌপ্য দিয়ে তৈরি ছাইদানি, মঙ্গোলিয়ার উত্পাদিত চর্মনির্মিত বুটজুতা , আয়না ও আরো বিভিন্ন সৌখিন জিনিস।
মানচৌরিয়ায় চীন ও রাশিয়ার বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে এ জায়গায় গেলে মনে হবে দুটি দেশ ভ্রমণ করছি। ফলে মানচৌরিয়া সত্যিকার অর্থেই একটি ভ্রমণের ভালো জায়গা। মানচৌরিয়ার মেয়র উ হাও ফাং গর্বিত কণ্ঠে বলেছেন, "মানচৌরিয়া চীন, রাশিয়া ও মঙ্গোলিয়া এ তিনটি দেশের সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত রয়েছে বলে তিনটি দেশের সংস্কৃতি এখানে ভালোভাবে মিশে আছে। চীনের অনেক অন্তর্দেশিয় শহর মানচৌরিয়ার মতো এমন আন্তর্জাতিক বরফ উত্সব আয়োজনের সুযোগ নেই। এটা হচ্ছে আমাদের বৈশিষ্ট।"
|