সাম্প্রতিক ত্রিশ বছরে উত্তর চীনের শানতুং প্রদেশের ইয়ানতাই শহর নিজের সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ , স্বয়ংসম্পূর্ণ বুনিয়াদী ব্যবস্থা ও গভীর বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি শক্তির দ্বারা বিপুল পরিমাণ বিদেশী পুঁজি আকর্ষণ করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের মূলভূভাগে তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের পুঁজি বিনিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র দক্ষিণাঞ্চল থেকে যথাক্রমে দক্ষিণাঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছে। ফলে ইয়ানতাই তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের পুঁজি বিনিয়োগের শ্রেষ্ঠ যুগে প্রবেশ করেছে।
গত শতাব্দীর আশির দশকে ইয়ানতাইয়ে প্রথম তাইওয়ানী ব্যবসায়ী দল এসেছেন। তাঁরা স্বচক্ষে ইয়ানতাইয়ের পুঁজি বিনিয়োগের পরিবেশ দুর্বল থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়া দেখেছেন। মিঃ চিয়াং চেন পিং তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন। ১৯৮৯ সালে তিনি ইয়ানতাই শহরে এসে ইয়ানতাই সর্বাধুনিক পরিমাপ যন্ত্র লিমিটেড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর কোম্পানিতে গাড়িতে ব্যবহৃত পরিমাপ যন্ত্র উত্পন্ন হয়। এ কোম্পানি প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকের কথা স্মরণ করে তিনি বলেছেন, "কোম্পানিটি নির্মাণের প্রথম দিকে আমরা অনেক দেরিতে কাজ করতাম। মাঝেমাঝে সময় মতো ভাত খেতে পারতাম না। এমন কি দেরি হওয়ায় রেস্তোরাও বন্ধ হয়ে যেত। কোথাও খাবার পেতাম না।"
পরিশ্রমী মিঃ চিয়াংয়ের একটি অভ্যাস আছে, তা হচ্ছে আজকের কাজ কোন মতে আগামীকালের জন্য রেখে দেন না। এর ফলে তিনি প্রায়শঃ গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করেন। কিন্তু তত্কালীন ইয়ানতাই শহরের পরিসেবা শিল্প তেমন উন্নত ছিল না। ফলে কাজ করার পর মিঃ চিয়াং কেবল তাত্ক্ষণিক পরিবেশন যোগ্য নুডলস খেতে পারতেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইয়ানতাই শহরের বিভিন্ন বুনিয়াদী ব্যবস্থার লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। এখন মিঃ চিয়াংয়ের গভীর রাতে খাবারের জন্য আর মাথা ঘামাতে হয় না। সম্প্রতি তাইওয়ানের ইলেকট্রন ক্রাফ্ট ইউনিয়ন মূলভূভাগের বিভিন্ন অঞ্চলের পুঁজি বিনিয়োগ পরিবেশ, ঝুঁকি ও প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা সংক্রান্ত পর্যালোচনা করেছে। এর ফলাফল অনুযায়ী, ইয়ানতাই শহর শ্রেষ্ঠ শহরের অন্যতম হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।
২০০১ সালে চিয়াং চেন পিং বন্ধুর সহযোগিতায় ৫০ লাখ মার্কিন ডলার পুঁজি বিনিয়োগ করে ইয়ানতাই ওয়ানক খাদ্য লিমিটেড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। অল্প দিনের মধ্যে এই কোম্পানির উত্পাদিত "ওয়ান চিয়া সিয়াং" নামে সয়া স্যস্ শানতুং প্রদেশে সুনাম ছড়িয়েছে। নিজের ব্যবসায় সাফল্য অর্জনের কারণ প্রসঙ্গে মিঃ চিয়াং মনে করেন, এর দুটি প্রধান কারণ আছে। একটা হচ্ছে নিজের পরিশ্রম। আরেকটা হচ্ছে স্থানীয় সরকারের নানা ক্ষেত্রের সহযোগিতা। ২০০৩ সালে চিয়াং চেন পিং ইয়ানতাইয়ের তাইওয়ানী ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক নির্বাচিত হন। তাঁর কার্যমেয়াদে তিনি ইয়ানতাই শহরে ব্যবসা করার জন্য অনেক তাইওয়ানী শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করেছেন। তিনি বলেছেন, "গত দু'তিন বছরে অনেক তাইওয়ানী ব্যবসায়ী ইয়ানতাই এসেছেন। আমাদের এ সমিতির সদস্যের সংখ্যাও বেড়েছে। আমরা সদস্যদের কাছে পুঁজি বিনিয়োগের নানা তথ্য জানাই। আমরা তাঁদেরকে বলি কোন কোন জায়গা অপেক্ষাকৃত ভালো। আরো কিছু লোক ব্যবসার সময় কোন সমস্যার শিকার হলে আমরা তা সমাধানে সাহায্য করি। "
তাইওয়ানী ব্যবসায়ী লিন কুং সোং তাইওয়ানী ব্যবসায়ী সমিতির সাহায্য পেয়েছেন। তিনি সংবাদদাতাকে বলেছেন, ইয়ানতাইয়ের শ্রেষ্ঠ শর্ত ও তাইওয়ানী ব্যবসায়ী সমিতির পরিসেবা হচ্ছে তাঁর ইয়ানতাই শহরে পুঁজি বিনিয়োগের প্রধান কারণ। ইয়ানতাই শহরে দীর্ঘকাল ধরে উন্নয়ন করতে চাইলে তিনি মনে করেন , ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু দিন আগে তাঁর নতুন স্থাপিত রেশম কারখানা সাজসরঞ্জাম কেনার সময় কেউ কেউ রেডিমেড্ পণ্য কিনে ব্যয় কমানোর প্রস্তাব করেছে। কিন্তু তিনি তা করেন নি। তিনি বলেছেন, "আমার মনে হয়, একটি নতুন গাড়ি কেনা আর একটি রেডিমেড্ গাড়ি অবশ্য কেনার অনুভুতি ভিন্ন। যেমন একটি নতুন গাড়ি চালিয়ে একটি দরিদ্র ও পশ্চাত্পদ গ্রামে গেলে গাড়ি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু যদি তুমি সস্তা দামে একটি রেডিমেড্ গাড়ি কিনে সেই গ্রামে যাও, হয়তো মধ্য পথে তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ব্যবসা ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। আমার কারখানার উত্পাদনের পরিমাণ খুব বেশি না হলেও আমি আশা করি, আমাদের উত্পাদনের গুণগত মান সবচেয়ে ভালো।"
লিন কোং সোং কেবল পণ্যভোগীদের জন্য ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করেন তাই নয়, তিনি তাঁর কর্মচারীদের প্রতিও একই মৌলিক নীতি অনুসরণ করেন। তিনি বলেছেন, তাঁর কার্যালয়ের দরজা সাধারণত বন্ধ থাকে না। যে কোন কর্মচারী সরাসরি তাঁর কাছে আসতে পারেন। কোম্পানিতে মতামত বক্স আছে। কর্মচারীদের কোন কথা থাকলে সরাসরি তাঁকে বলতে অসুবিধা হলে তাঁকে চিঠি দিতে পারেন।
একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশের পর তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদেরপুঁজি বিনিয়োগের প্রধান ক্ষেত্র চীনের মূলভূভাগের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ক্রমে ক্রমে উত্তরাঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছে। অধিক থেকে অধিকতর তাইওয়ানী ব্যবসায়ী মিঃ চিয়াং ও লিনের মতো ইয়ানতাই শহরে এসে পুঁজি বিনিয়োগ করেন। ২০০৬ সালের শেষ দিক পর্যন্ত ইয়ানতাই শহর মোট ১৩২০টি তাইওয়ানের পুঁজি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। মোট ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার তাইওয়ানী পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই পরিমাণ শানতুং প্রদেশে তাইওয়ানী পুঁজি বিনিয়োগের মোট পরিমাণের এক চতুর্থাংশ।
ইয়ানতাই কেন তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের আকর্ষণ করতে পারে? এক দিকে, স্থানীয় সরকার নিরন্তরভাবে তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের আকর্ষণের মাত্রা জোরদার করে আসছে। প্রতি বছর ইয়ানতাই পৌর সরকারের প্রতিনিধি দল দক্ষিণ চীনে গিয়ে তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের পুঁজি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন যোগাযোগ করে। অন্য দিকে, ইয়ানতাই যন্ত্র ও বিদ্যুত্ শিল্প উন্নয়নের কৌশল নির্ধারণ করেছে। এর ফলে তাইওয়ানের ইলেকট্রনিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ইয়ানতাই শহরে পুঁজি বিনিয়োগের খাত দ্রুত বিকশিত করেছে।
ইয়ানতাই শহরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ওয়াং সিয়াও চেন বলেছেন, "তাইওয়ানী পুঁজি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো শানতুং প্রদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের কাঠামো পরিবর্তন করা এবং শানতুং প্রদেশের রপ্তানী পণ্যের মধ্যে যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক সামগ্রির পরিমাণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শানতুং প্রদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।"
|