পেইচিং শহরের পূর্বাংশে অবস্থিত নানসিনছাং হচ্ছে মিং ও ছিং এই দুটি রাজবংশের রাজকীয় শস্যাগার। ৬০০ বছরের ইতিহাস সম্পন্ন নানসিনছাং পেইচিংয়ের রাজপ্রাসাদের প্রায় সম বয়সী। এটা হচ্ছে চীনের বৃহত্তম ও অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে সংরক্ষিত প্রাচীন রাজকীয় শস্যাগার। এখন অতীতের রাজকীয় শস্যাগার পেইচিংয়ের একটি সবচেয়ে আধুনিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সাংস্কৃতিক এলাকায় পরিণত হয়েছে।
নানসিনছাং সংস্কৃতি রাস্তা পেইচিংয়ের একটি প্রধান পরিবহন লাইন --- পিংআন রাস্তায় অবস্থিত। এর আয়তন কয়েক হাজার বর্গমিটার। এর প্রধান স্থাপত্য হচ্ছে প্রাচীনকালের নয়টি বিরাট শস্যাগার। শস্যাগারের প্রাচীর পেইচিং শহরের প্রাচীন দুর্গপ্রাচীরের মত একই ধরনের ইট দিয়ে তৈরী। জানা গেছে, অতীতে এখানে ১৩০টিরও বেশি শস্যাগার ছিল। প্রায় ৫ কোটি কিলোগ্রাম খাদ্যশস্য জমা থাকতো। নানসিনছাংয়ের ইতিহাস সম্পর্কে নানসিনছাংয়ের কর্মকর্তা চাও জি ঈ বলেছেন, "আগে নানসিনছাং পেইচিংয়ের দুর্গপ্রাচীরের পাশে ছিল। তত্কালীন দুর্গপ্রাচীরের বাইরে দুর্গপরিখা ছিল। দুর্গপরিখা চীনের জলপথের প্রধান লাইন --- পেইচিং থেকে হাংচৌগামী মহান খালের সঙ্গে সংলগ্ন। নানসিনছাং-এর এমন একটি জায়গায় নির্মাণ করার কারণ হচ্ছে জলপথের দ্বারা খাদ্যশস্য পরিবহন করতে সুবিধাজনক।"
মিঃ চাও বলেছেন, নানসিনছাং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক অর্থাত্ ছিং রাজবংশের শেষ দিক পর্যন্ত শস্যাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পরবর্তীকালে যুদ্ধের সময় এখানে গোলাগুলি জমা রাখা হতো। ১৯৪৯ সালের পর এটি পেইচিং বিভাগীয় কোম্পানীর নানা নিত্য-ব্যবহার্য্য দ্রব্য জমা রাখার গুদামে পরিণত হয়। এখন নানসিনছাং এলাকায় অনেক ফ্যাশন উপাদান জড়িয়ে আছে। যেমন আধুনিক চারুশিল্পের প্রদর্শনী-ঘর, ব্যক্তিগত চেম্বার, ল্যাতিন নৃত্য ক্লাব, ডিস্ক কেন্দ্র, বিশিষ্ট রেস্তোরা ও ঐতিহ্যিক চা দোকানসহ অনেক কিছু । এ দোকানগুলো অতীতের উজ্জ্বল রাজকীয় শস্যাগারের সঙ্গে মিলে এক বৈশিষ্ট্যপুর্ণ কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
নানসিনছাং রাস্তার কেন্দ্রে অবস্থিত সবচেয়ে প্রাচীন ও অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে সংরক্ষিত শস্যাগার এখন "সংগীত ভবন ক্লাব" নামে একটি ডিস্ক প্রদর্শনী কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। অতিথিরা এর ভিতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে স্থাপত্যের জন্য আকৃষ্ট হয়। ব্যবসায়ী এই শস্যাগার ভাড়া করে লাখ লাখ ইউয়েন রেনমিনপি ব্যয় করে পূর্বের মত করেই এই প্রাচীন স্থাপত্যকে নতুন করে সাজিয়েছেন। এতে আধুনিক শিল্পকলার পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। এ কোম্পানির দায়িত্বশীল কর্মকর্তা শাও তুং হোং বলেছেন, নিয়ম অনুযায়ী, প্রাচীন স্থাপত্যে সাজানোর সময় কোন কিছু ঙেগে দেয়া বা সরানোর কাজ করা যায়। ফলে সাজানোর সময় তারা স্থাপত্যের প্রধান অংশ নষ্ট করে নি। দরকার হলে সাজানোর উপাদানগুলো সহজভাবে সরিয়ে নিয়ে দ্রুতই প্রাচীন স্থাপত্যের আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনা হবে। কারণ তারা প্রাচীন স্থাপত্যের ক্ষতি হতে হয় , এমন কোন ক্ষতিকর কাজ করে নি। তিনি বলেছেন, "এ স্থাপত্য ইউরোপের প্রাচীন দুর্গের সঙ্গে তুলনার চেয়েও বেশী। আমরা মনে করি, এটা একটি অমূল্য জিনিস। এমন একটি মূল্যবান জিনিস আপনার হাতে আসলে সত্যি সত্যি তাকে যত্ন করতে হবে। তার সৌন্দর্য অন্বেষণ করতে হবে।"
ম্যাডাম শাও বলেছেন, এই প্রাচীন শস্যাগার সংরক্ষণের জন্য সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় , সে জন্য প্রাচীরকে ডিজাইনার কাচ দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। এভাবে স্থাপত্যের মূল চেহারা সংরক্ষণের পাশাপাশি অতিথিরা প্রাচীরের ইটও দেখতে পাবেন। জানা গেছে, কিছু দিন পর এখানে একটি ছোট আকারের কুন অপেরার নাট্যশালা হবে। উদ্যোক্তারা আশা করেন, কুন অপেরা এমন একটি স্থাপত্যে সম্প্রসারিত হবে।
নানসিনছাং রাস্তায় দশ বারোটি বিশিষ্ট রেস্তোরা আছে। পেইচিং পৌর সরকারের সংশ্লিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী, প্রাচীন স্থাপত্যে আগুন লাগিয়ে রেস্তোরা খোলা যায় না। ফলে এই রেস্তোরাগুলো অনুকরণপ্রবণ স্থাপত্যে খোলা হয়। প্রত্যেক স্থাপত্যের বিলাসী চেহারা ও খাবারের জায়গা আছে। রাজকীয় শস্যাগারের পাশে দাঁড়ালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার শক্তির সৃষ্টি হয়। যারা সুস্বাদ্যু খাবার ও রেস্তোরার সু-পরিবেশ পছন্দ করেন, তাদের জন্য এখানে প্রবল আকর্ষণীয় শক্তি আছে। নানসিনছাং এলাকায় পিকিং ডাক, জাপানী খাবার ও ইউনান প্রদেশের বিশেষ খাবারসহ ফরাসী খাবার পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন তাইওয়ানী রেস্তোরা আছে। এ রেস্তোরার একটি মজার নাম আছে, তা হলো "খাবারের আগে ও পরে" । রেস্তোরার ম্যানেজার লি ইয়াং বলেছেন, তাদের এখানে রেস্তোরা খোলার কারণ হচ্ছে তারা রাজকীয় শস্যাগারের বৈশিষ্ট্যময় সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। তিনি বলেছেন, "এমন গভীর ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক পরিবেশে রেস্তোরা চীনে আর নেই। প্রাচীনকালের শস্যাগার হচ্ছে খাদ্যশস্য রাখার জায়গা। এখানকার আশেপাশের পরিবেশ খুব ভালো। রেস্তোরা খোলার ভালো জায়গা।"
খাবারের আগে ও পরে রেস্তোরা তাইওয়ানের বিশেষ খাবার ছাড়াও আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির পরিবারের খাবার রান্না করে থাকে। চীনাদের কাছে সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার হচ্ছে নিজের বাড়িতে রান্না করা খাবার। কারণ অতীতে চীনারা বাড়িতে সুস্বাদু খাবার রান্নার জন্য সময় ও ব্যয়ের কথা খুব বেশি বিবেচনা করতো না। ফলে কেবল বাসায় চমত্কার ও সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায়। এ রেস্তোরার মালিক বন্ধুদের মাধ্যমে রাজনীতি, ক্রিড়া ও সংস্কৃতি মহলের কিছু নামকরা ব্যক্তিদের অনুমোদন পেয়ে তাঁদের পরিবারের বিশেষ কিছু খাবারের রান্নার পদ্ধতি শিখেছেন। এ খাবারগুলো অন্যান্য রেস্তোরায় পাওয়া যায় না। রেস্তোরায় নামকরা ব্যক্তিদের স্বাক্ষর করা প্রশংসা পত্রও প্রদর্শিত হচ্ছে।
নানসিনছাংয়ের রেস্তোরায় মাথাপিছু ব্যয় ৫০ থেকে ৩০০ ইউয়ান রেনমিনপির মতো। তা ছাড়াও পর্যটকরা নানসিনছাংয়ের অলংকার ও দুর্লভ শিল্পবস্তু সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সেখানে বেড়াতে যেতে পারেন।
|