চিংদেচেন
চিংদেচেন চীনের মধ্যাংশের চিয়াংশি প্রদেশে অবস্থিত। এ শহরকে চীনামাটি দিয়ে সাজানো নগর বলা যায়। শহরের সবদিকে চীনামাটির তৈরি ইট দিয়ে বানানো দেওয়াল দেখা যায়। চীনামাটির টুকরো দিয়ে গতিপথ বসানো হয়। তা ছাড়া সড়ক দ্বীপ, ভাস্কর্য ও দেওয়াল ছবিগুলো সবই চীনামাটি দিয়ে সাজানো । চিংদেচেনের উত্পাদিত "মাও শে তুংয়ের ব্যবহৃত চীনামাটি", শাংহাইয়ের "এপেক" ও জাতীয় অতিথি ভবনে ব্যবহৃত চীনামাটি সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। কেউ কেউ বলেন, চিনদেচেনের চীনামাটি মণির মতো সাদা ও কাগজের মতো পাতলা। ২০০৬ সালে চীনের ৩১টি পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত "বিদেশী পর্যটকদের চোখে চীনের ৫০টি সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান" এর নির্বাচনে চিংদেচেন ১৯তম স্থান লাভ করেছে। এর প্রধান কারণ তার চীনামাটির বৈশিষ্ট্য।
চিংদেচেনের "চীনামাটির বৈশিষ্ট্য" সব জায়গায় দেখা যায়। বিশেষ করে তার ছোটখাটো গলিপথে। চিংদেচেনের অনেক অধিবাসীই অতিতে এমন গলিপথে বাস করতেন। সামনের বাড়িঘর দোকান হিসেবে ব্যবহার করা হতো, পিছনের উঠোনে থাকতো কারখানা । সেখানে বেস তৈরি করার পর আগুনের ভিতরে রেখে চীনামাটি উত্পাদিত হত। কয়েক শতাব্দী পার হয়েছে। এখন এখানকার বাড়িঘরের নিচে অসংখ্য টুকরো অবশিষ্টাংশ লুকিয়ে আছে। মজার কথা হচ্ছে, যারা বাড়িঘর নতুন নির্মাণ করেন, তারা প্রায়শঃই মাটির নিচ থেকে মূল্যবান প্রাচীন চীনামাটি আবিষ্কার করেন।
চীনামাটির রাস্তা হচ্ছে চিংদেচেনের "চীনামাটির বৈশিষ্ট্যের" আরেকটি প্রতিনিধিত্বকারী দিক। চীনামাটির রাস্তা চিংদেচেনের পুরনো অঞ্চলের কেন্দ্রে অবস্থিত। স্থানীয় ব্যক্তিরা মনে করেন, এ রাস্তা হচ্ছে চিংদেচেনের চীনামাটি সংস্কৃতির বিন্দুরূপ। কিন্তু চীনামাটির রাস্তা এ নামটি কিভাবে এসেছে? এর পিছনে একটি গল্প আছে। বহু বছর আগে এই রাস্তায় একটি বড় চীনামাটির দোকান ছিল। দোকানের মালিক মারমুখী। তার কয়েকটি নেড়ি কুকুর ছিল। সেই কুকুরগুলো গরীব লোকদের দেখলে চিত্কার করে ডাকতো এবং কামড়ে দিতো। কিন্তু ধনী ব্যক্তি আসলে দোকানের মালিক হাঁসি মুখে অভ্যর্থনা জানাতেন। তার কুকুরও লেজ নাড়তো। অন্যান্য দোকানী ও ক্রেতাদের তা দেখে রাগ হলেও কোন উপায় ছিল না। পরে একজন যাদুকর বৃদ্ধ কোন একটি উপায়ে ঐ কুকুরগুলোকে পাগল করে দিয়েছেন। কুকুরগুলো দোকানের ভিতর ও বাইরে লাফালাফি করে, দোকানের সমস্ত চীনামাটিকে ভেঙে দিয়েছিল। চীনামাটির টুকরো টুকরো অংশ পুরো রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকেই এই রাস্তার নাম "চীনামাটির রাস্তা" হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
৬০ বছর বয়স্ক মিঃ জুপ কাপেল হচ্ছেন নেদারল্যান্ডের জাতীয় শিল্পকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। তিনি চল্লিশ বছর ধরে চীনামাটি শিল্পের গবেষণা করেছেন। কিছু দিন আগে কাপেল ছুটির দিনে চিংদেচেনে এসে চীনামাটি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি বিশেষ করে চিংদেচেনের গলিপথে হাঁটতে পছন্দ করেন। এখানে সত্যিকার চীনামাটি শিল্প অনুভব করা যায়। তিনি বলেছেন, "চিংদেচেনের প্রতিটি গলিপথেরই নিজের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের চীনামাটি ও অলঙ্কার দেখা যায়। এমন কি পথও বিভিন্ন রকমের চীনামাটির টুকরো বসানো। আর যেতে ইচ্ছে করে না।"
চীনামাটির রাস্তার দু'পাশে রয়েছে হুইচৌ টাউন হল, নান ছাং টাউন হল, সুহু টাউন হল, লিনচিয়াং টাউন হল ইত্যাদি স্থাপত্য। শহরের নামে নামকরণকৃত স্থাপত্যগুলো চীনের অন্য অঞ্চলের চীনামাটি ব্যবসায়ীদের অভ্যর্থনার জন্য নির্মিত হয়েছে। ফলে চীনামাটির রাস্তায় চীনের দক্ষিণাঞ্চল বা উত্তরাঞ্চলের সব দিকের আঞ্চলিক ভাষা শোনা যায়। খুব মজা।
ড্রাগন গামলা
চীনামাটি রাস্তার অদূরে অবস্থিত আরেকটি বিখ্যাত জায়গা আছে, এর নাম "লুংকুং গলিপথ" অর্থাত্ " ড্রাগন গামলা গলিপথ"। "ড্রাগন গামলা" হচ্ছে প্রাচীনকালে চিংদেচেনের রাজকীয় চীনামাটি কারখানায় তৈরি এক রকম সরকারী ব্যবহারিক বড় আকারের গামলা। বিশেষ করে রাজপ্রাসাদে অগ্নি প্রতিরোধের সময় এটা ব্যবহার করা হতো। এ গামলার ওপর ড্রাগনের ছবি আঁকা থাকায় তাকে "ড্রাগনগামলা" বলা হয়।
"ড্রাগন গামলায়" ঘা দিলে যে শব্দ বের হয় , তা অন্যান্য চীনামাটির পণ্যের শব্দের চেয়ে সুললিত। "ড্রাগণ গামলার" আকার খুব বড়, ফলে সহজে তৈরী করা যায় না। একটা ড্রাগন গামলা তৈরী করতে সাধারণতঃ ১৯ দিন সময় লাগে। তা হলেও এর সফল তার হার মাত্র ৫ শতাংশ । সুতরাং সম্রাট বা উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জোর করে আদেশ না দিলে কেউ ড্রাগন গামলা তৈরি করতে চায় না।
চিংদেচেনের চীনামাটি প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা একাডেমির প্রদর্শনী হলে একটি ড্রাগন গামলা আছে। প্রদর্শনী হলের পরিচালক সিয়াও ফাং বলেছেন, "আমরা দেখতে পাচ্ছি এ ড্রাগন গামলা মিং রাজবংশের সময় তৈরী । তার পেটে দুটি ড্রাগন আঁকা রয়েছে। ড্রাগনের মুখের সামনে অগ্নি গোলক বল আছে। এর অর্থ হচ্ছে অগ্নিকে বের করা।"
চিংদেচেনের উত্তর-চীন রাস্তায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও দুই মিটার প্রস্থ একটি ছোট গলিপথ আছে। তার একটি সুন্দর নাম আছে , অর্থাত্ "ড্রাগন নৌকা রাস্তা"। নাম শুনে বুঝা যায়, এ রাস্তার আকার একটি ড্রাগন নৌকার মতো। জানা গেছে, এক হাজার বছর আগেকার সোং রাজবংশ থেকে এখানে চীনামাটির শ্রমিকরা বসবাস করেন। তারপর ধীরে ধীরে এখানে একটি বিশেষ রাস্তার সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তার পূর্বাংশে পাঁচ দেবতা মন্দির আছে। এর প্রতিপক্ষে ছোট আকারের একটি ড্রাগন মন্দির আছে, এর ভিতরে একটি ড্রাগনের মাথার মূর্তি , তাতে শ্রদ্ধাতর্পন করা হয়। প্রতি বছর লন্ঠন উত্সবে অধিবাসীরা এখানে এসে ড্রাগনের মাথার প্রতি প্রার্থনা করে, ড্রাগনের লন্ঠন নিয়ে খেলে, রাস্তায় মিছিল করে এবং সুখ-শান্তির কামনা করে।
চিংদেচেনের বেসরকারী চীনামাটি যাদুঘরের উপ-পরিচালক পাই কুয়াং হুয়া বলেছেন, "চিংদেচেন একটি বিশেষ জায়গা। এখানে কেবল বহু প্রাচীন কারখানা রয়েছে তাই নয়, বরং আরো অনেক চীনামাটির ইট দিয়ে নির্মিত স্থাপত্যও রয়েছে। এটাও চিংদেচেনের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার মধ্যে সমৃদ্ধ চীনামাটির সংস্কৃতির বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।"
চিংদেচেন একটি বড় শহর নয়, তবে তার চীনামাটির বৈশিষ্ট্য সত্যি সত্যি আকর্ষণীয়। যদি আপনার সুযোগ হয়, তাহলে এখানে একবার বেড়াতে আসুন। এখানে চীনামাটি ছাড়া আরো অনেক বিশিষ্টময় খাবার আছে। সে খাবারগুলো সাধারণ সান্ধ্যকালীন বাজারে পাওয়া যায় এবং খুব সস্তা।
|