বিশ্বায়নের আজ আন্তর্দেশীয় বিবাহ আর কম দেখাবার কিছু নয় । ভিন্ন সাংস্কৃতিক পটভূমিতে ভিন্ন দেশের যে প্রেমিকপ্রেমিকাদের বিয়ে হয়েছে তবে তাদের মধ্যে কোনোনা কোনোকারণে স্বামী-স্ত্রীরএই সুন্দর বিবাহ টিকে থাকতে পারেনি । পক্ষান্তরে কোনো কোনো স্বামী-স্ত্রী ভালবাসা ও বড় মন দিয়ে পরস্পরের পার্থক্যকেগ্রহণ করে সুখী জীবন যাপন করছেন । এই কারণে আশেপাশে লোকেরা তাদের খুব ইর্ষা করে ।
দুজনের পরিচয় সম্পর্কে সুনসিয়াও বলেছেন ,আমি এবং আমার স্বামী দুজন পেইচিং সাইন্স ও টেকনলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ছিলাম । আমি ইংগরেজ বিভাগের ছাত্রী । দু-এক বছর মেলামেশার পর ১৯৯১ সালে আমাদের বিয়ে হয় । প্রথমে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার অনেক কম জানা ছিল। পরস্পরকে ভালবাসার কারণে আমাদের মিলন হয় । সে সময় আমার বাবা মা এবং বাড়ির সবাই হুনান প্রদেশে থাকতো। ১৯৯৫ সালে স্বামীর ব্যবসার প্রয়োজনে আমরা পরিবার সহ বাংলাদেশে ফিরে যাই । সেখানে একটানা আমি পাঁচ বছর কাটিয়েছি ।
তিনি বাংলাভাষা জানেন কি না ,তিনি কিভাবে স্থানীয় লোকের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এই প্রশ্নের উত্তরে সুনসিয়াও বলেন, সে সময় আমি একটি বাংলা অক্ষরও জানতাম না । আমার স্বামী আমাকে বিদেশীদের জন্যে বাংলা শেখার বই কিনে দিলেন । এর পর থেকে আমি বাংলা অক্ষর ও কিছু সহজ বাক্যের উচ্চারণ শিখি । আমি মনে করি, মন দিয়ে শিখলে বাংলা তত কঠিন নয় । বাড়ির সবাই আমার শিক্ষক ।এমনকি যখন বাড়ির ড্রাইভার বা বাবুর্চি বাজার করতে যান তখন আমি প্রায়ই তাদের সঙ্গে যাই । ভাষার পরিবেশের প্রভাবে আমি তাড়াতাড়ি বাংলা শিখে সবার সঙ্গেইমত বিনিময় করতে সক্ষম হয়েছি । ইংরেজী দিয়েও স্থানীয় লোকের সঙ্গে মত বিনিময় করতে পারি । কিন্তু স্থানীয় লোকেরা নিজের মাতৃভাষা বলতে অভ্যস্ত। তাই আমি বাংলা ভাষা শিখেছি । বাংলাভাষা শেখা আমার পক্ষে স্থানীয় লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনেক সুবিধা হয়েছে ।
নিজের দুই বাচ্চা সম্পর্কে সুন সিয়াও বলেন ,যখন আমরা বাংলাদেশে ফিরে যাই তখন আমার বড় ছেলের বয়স মাত্র কয়েক মাস ছিল । সে বাংলাদেশে একটানা ৫ বছর কাটিয়েছে বলে সে ভালই বাংলা কথা বলতে পারে । যখন আমরা বাংলাদেশ থেকে চীনে ফিরে আসি তখন আমার মেয়ের বয়স মাত্র এক বছর । তাই সে অল্প কিছু জানে ।
সাধারণত বাংলাদেশের নারীরা বিয়ের পর আর কাজ করেন না ,তারা বাড়িতে বাচ্চাকে দেখাশোনা করেন । তার বর্তমান অবস্থা কি রকম ? তিনিও বাংলাদেশী নারীদের মতো বাড়িতে বাচ্চাকে দেখাশোনা করেন ? সে সম্পর্কে সুনসিয়াও বলেন, আমার অবস্থাও এ রকম । আমার সাহেব কাজে অত্যন্ত ব্যস্ত । বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে বুয়াকে দিতে আমি চাই না । তাই আমি কাজ ছেড়ে বাড়িতে নিজেই বাচ্চাদের দেখাশোনা করি । বাচ্চাকে দেখাশোনা ,পারবারিক কাজ ছাড়া বাড়ির আরও অনেক কাজ আমাকে করতে হয় । চীনের প্রবাদ অনুযায়ী আমার স্বামী বাইরে কাজ করেন আর আমি বাড়ি পরিচালনা করি । আমরা সমানভাবে সুখশান্তিতে জীবনযাপন করছি ।
দৈনন্দি জীবনে ভিন্ন সাংস্কৃতিক পটভূমির কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি ? থাকলে তারা কিভাবে এই সব সমস্যার সমাধান করেন ? এ সম্পর্কে সুন সিয়াও বলেন , আমাদের মধ্যে প্রথম দিকে এ ধরণের সমস্যা হয়েছিল । ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষার কারণে বিয়ের প্রথম দিকে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল । যেমন এ বিষয়ে আমি এভাবে ভাবিনি । কিন্তু সে মনে করে , আমি ওভাবে ভেবেছি । আর খাবারের পার্থক্য, যে খাবার খেতে আমার ভাল লাগে সেটা সে গ্রহণ করে না । আর তার পছন্দীয় খাবার আমিও গ্রহণ করতে পারি না । বহু বছর ধরে জীবযাপনের মাধ্যমে আমরা পরস্পরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠেছি । আমি মনে করি, সমঝোতাপূর্ণ মন দিয়ে প্রতিপক্ষের পার্থক্য গ্রহণ করলেই কেবল সমস্যার সমাধান করা যায় ।
বাচ্চাদের শিক্ষাসম্পর্কে সুন সিয়াও বলেন, আমার বাচ্চাদের বয়স
এখন কম । ভাল ভিত্তি স্থাপন করা বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার । বড় হলে তাদেরকে তৃতীয় দেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পাঠাব কথাটা ভেবে রেখেছি। কিন্তু এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি । বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে দিন কাটিয়েছি বলে আমার বাচ্চারা বিশেষ করে বড় ছেলে বাংলা খাবার খেতে পছন্দ করে । প্রতিবেশীদের বাচ্চারাও খেতে পছন্দ করে । যখন বাড়িতে ভোজসভার আয়োজন করি, তাদেরকে দাওয়াত করলে তারা খুব খুশি হয় । প্রথম দিকে আমি ভাল করে বাংলা খাবার রান্না করতে জানতাম না । কিন্তু বাচ্চাদের জন্য আমি শিখেছি । আমি বলতে চাই , মন দিয়ে শিখলে কোন কিছুই কঠিন নয় ।
সুন সিয়াও চীনা মেয়ে , স্বামী বাংলাদেশী ।তারা স্বামী-স্ত্রী ১০-১২ বছর ধরে সংসার করেছেন । নিজের অভিজ্ঞাতা সম্পর্কে সুন সিয়াও বলেন , ভিন্ন দেশের প্রেমিক-প্রেমিকা বিয়ে করার পর তাদের পারিবারিক জীবন সম্ভবত সাধারণ পরিবারের চেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হবে । সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে সমস্যাও ভিন্ন । এই সময় স্বামী-স্ত্রীদুজন দুজনকে উদার মন দিয়ে পরস্পরের সংস্কৃতিকেগ্রহণ করতে হবে । পরস্পরের গুণ নিয়ে নিজনিজদের ভুলত্রুতি সংশোধন করতে হবে ।এইভাবে যে কোনো দেশের যে কোনো জাতির সংস্কৃতিরই হোক না কেন সবাই ভাল করে সহাবস্থান করতে পারবে ।
|