চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হেইলোংচিয়াং প্রদেশের হারবিন শহরে বছরের মধ্যে পাঁচ মাস গড়পড়তা তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে থাকে। ফলে হারবিন শহর "বরফ নগর" নামে সুপরিচিত। তীব্র শীত হারবিনের অধিবাসিদের অশেষ অনুপ্রেরণা দিয়েছে। তাঁরা বরফ ও তুষার দিয়ে শীতকালীন হারবিনকে রূপকথার মতো সাজান।
হারবিন উচু অক্ষাংশ অঞ্চলে অবস্থিত। শীতকালে হারবিনের তাপমাত্রা মাইনাস বিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকে। ফলে হারবিন নিজস্ব "বরফ সংস্কৃতি" গড়ে তুলেছে এবং চীনের হারবিন আন্তর্জাতিক বরফ উত্সব স্থলে পরিণত হয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে প্রতি ৫ জানুয়ারী হারবিনের বরফ উত্সবের উদ্বোধন হয়। সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দেশি-বিদেশি অতিথিরা আসেন।
বরফ উত্সব একটানা ১০০ দিন চলতে থাকে। বরফ উত্সব চলাকালে হারবিন শহরের রাস্তায় রাস্তায় বরফ ভাস্কর্য দেখা যায়। আপনি সেখানে বরফ দিয়ে তৈরি পিয়ানো, ঝাঁটার উপরে বসানো হেরি পোর্ট আর পেইচিং অলিম্পিক গেমস ২০০৮ এর কল্যাণমুলক বস্তু ফুওয়া দেখতে পারেন। সেখানকার বরফ ভাস্কর্য কেবল স্বচ্ছ তাই নয়, কোন কোন ভাস্কর্যের মধ্যে খাবারযোগ্য রং বা রঙিন প্র্রদীপ দেয়া হয়। সুতরাং রাতে বরফ ভাস্কর্য দেখতে খুব সুন্দর ও মনোরম।
কিন্তু বরফ ভাস্কর্য কিভাবে তৈরি হয়? আসলে হারবিনের পাশে অবস্থিত সোংহুয়াচিয়াং নদী এক বিরাট বরফ মাঠে পরিণত হয়। যেখানে বরফ সবচেয়ে গভীর , সেখানে গাড়ি চালানো যায়। হারবিনের অধিবাসীরা বিশেষ কাটার যন্ত্র দিয়ে বরফের বিভিন্ন রকম মূর্তি কাটেন। এই বরফ হচ্ছে বরফ ভাস্কর্য তৈরীর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক উপাদান।
দক্ষিণ চীনের কুয়াংতুং প্রদেশ থেকে আসা পর্যটক হুয়াং জে বিও বরফ ভাস্কর্য শিল্প খুব পছন্দ করেন। তিনি এই প্রথম বার বরফ ভাস্কর্য দেখেছেন। বরফ ভাস্কর্যের সৌন্দর্য তাঁকে মুগ্ধ করেছে। তিনি বলেছেন, "আমি মনে করি, বরফ ভাস্কর্য একটি অতি পবিত্র দুনিয়ার মতো। তা দেখে মানুষের মন পরিষ্কার হয়। খুব সুন্দর।"
রাস্তায় ও পার্কে বরফ ভাস্কর্য উপভোগ করার পাশাপাশি, আপনি সোংহুয়াচিয়াং নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত বরফ বিশ্ব পার্কে যেতে পারেন। বরফ বিশ্ব পার্কের আয়তন ৪ লাখ বর্গমিটার। এটা হচ্ছে হারবিন শহরের বৃহত্তম বরফ সম্পর্কিত পার্ক। সেখানে প্রাচীনকালের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভবন , রাজপ্রাসাদ, দুর্গ ইত্যাদি সবই বরফ দিয়ে তৈরি। প্রতি বছর বরফ বিশ্ব পার্কে এক বিশেষ প্রতিপাদ্য থাকে। যেমন চলতি বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে "চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মৈত্রী"। এখানে বরফ দিয়ে খোদাই করা দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক প্রাচীন স্থাপত্য আছে। যদি আপনি মনে করেন, এই স্থাপত্যগুলো কেবল দূর থেকে দেখা যায়, তা ভুল । আপনি বরফ দিয়ে তৈরি ধাপে হেঁটে হেঁটে ওপরে যেতে পারেন। ক্লান্ত হলে পার্কের ভিতরে বরফ দিয়ে তৈরি বারে গিয়ে কিছু ক্ষণ বসে শত বছরের ইতিহাস সম্পন্ন হারবিন বিয়্যার খেতে পারেন।
তুষার ভাস্কর্য
হারবিনে গেলে বরফ ভাস্কর্য ছাড়া তুষার ভাস্কর্যও দেখতে হবে। সোংহুয়াংচিয়াং নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত সূর্য দ্বীপ হচ্ছে তুষার ভাস্কর্য উপভোগ করার ভাল জায়গা। সূর্য দ্বীপে বায়ু খুব টাটকা, দুষণমুক্ত এবং তুষারের গূণগত মান ভালো। প্রতি বছর এখানে তুষার ভাস্কর্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর তুষার ভাস্কর্য মেলার প্রধান দৃশ্য হচ্ছে ২৫০ মিটার দীর্ঘ "নায়াগ্রা জলপ্রপাত"।
আপনি হয়তো জিজ্ঞেস করতে চান, তুষার খুব নরম , কিভাবে বিরাট আকারের ভাস্কর্য খোদাই করা যায়? তুষার ভাস্কর্য আর বরফ ভাস্কর্যের পার্থক্য কি? হারবিনের তুষার ভাস্কর্য মাস্টার চাং ইয়ু এর উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "বরফ ভাস্কর্য দেখতে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। বয়নের দ্বারা শিল্পীর মন প্রতিফলিত হয়। তুষার ভাস্কর্য প্রধানতঃ মূর্তি দিয়ে প্রসঙ্গ প্রকাশিত হয়। মাইনাস পাঁচ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে কৃত্রিম তুষার উত্পাদিত হয়। প্রথমে এই কৃত্রিম তুষারকে কাগজ দিয়ে তৈরি এক বড় বক্সের মধ্যে ভরা হয়। তারপর কাগজ বক্সকে সরিয়ে নেয়া হয়। এভাবে খোদাই করা তুষার তৈরি হয়।"
হারবিন অধিবাসীদের হাতে বরফ ও তুষার দিয়ে কেবল শিল্পকলা কাজ করা যায় তাই নয়, তা দিয়ে বিনোদন যন্ত্রও বানানো যায়। হারবিনের চাও লিন পার্কে ৬০ মিটার দীর্ঘ একটি বিরাট বরফ গোলকধাঁধাঁ আছে। গোলকধাঁধাঁর প্রস্থানের পথ খোঁজার সময় অবশ্যই একটু সাবধানে থাকবেন। না হলে সহজে হোঁচট খাবেন। অনেকে ছোট বেলায় গড়ানো খেলার যন্ত্র খেলতো। এখানে আসলে আপনারা দশ মিটার উচু বরফ গড়ানো খেলার যন্ত্র খেলতে ভুলবেন না। এর উপরে বসে দ্রুতই নেমে আসার সময় কানে বাতাসের শব্দ ভেসে আসে। হৃতপিণ্ডও দ্রুত উঠানামা। তা ছাড়া আপনি বরফ সাইকেলও চালাতে পারেন। বরফ সাইকেল সাধারণ সাইকেলের চেয়ে অনেক ছোট। স্কেইট সামনের চাকার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। পিছনের চাকার দু'পাশেও স্কেইট বোর্ড বসানো আছে। স্থানীয় শহরবাসী জি ওয়েই তুং আমাদের জানিয়েছেন, "বরফ সাইকেল চালানোর অনুভুতি বরফের ওপর ভেসে যাওয়ার মতো। "
আপনি আরো বেশি বরফ ক্রিড়ার মজা অনুভব করতে চাইলে সোংহুয়াচিয়াং নদীতে যান। শীতকালের সোংহুয়াচিয়াং নদী হচ্ছে হারবিন শহরের একটি প্রাকৃতিক খেলার মাঠ। এখানে পর্যটকরা কুকুরে টানা স্লেজ-গাড়িতে বসে সোংহুয়াচিয়াং নদীর দু'পারের সুন্দর দৃশ্য দেখতে পারেন। অথবা শীতকালীন সাঁতার অনুরাগীদের সাঁতার দেখতে পারেন। হারবিনের শীতকালীন সাঁতারের সুদীর্ঘকালের ইতিহাস আছে। এটা "সাহসীদের ক্রিড়া" বলা যায়। চীনের শীতকালীন সাঁতার অনুরাগীদের মধ্যে ২০ বছর বয়স্ক যুবকযুবতী আছেন, ৮০ বছর বয়স্ক বৃদ্ধবৃদ্ধাও আছেন। হারবিন শহরের অধিবাসী হান সু মেই সংবাদদাতাকে বলেছেন, শীতকালীন সাঁতার তাঁর কাছে শরীর শক্তিশালী করার ভালো উপায়। তিনি বলেছেন, "এখন আমার বয়স ৬২ বছর। আমি পাঁচ বছর ধরে শীতকালীন সাঁতার করেছি। প্রতি দিন আসি। আগে আমার গুরুতর শ্বাসনালী প্রদাহ ছিল। শীতকালীন সাঁতার করার পর আমি আর ঔষুধ খাই নি। দেখুন , এখন আমার শরীর কতো ভালো। আমি মনে করি, এ কয়েক বছর শীতকালীন সাঁতার কাটার ফলে আমার শরীর ভালো হয়েছে।"
বরফ ক্রিড়া সম্পর্কে বলতে গেলে আরেকটি কথা উল্লেখ করা যায়, তা হচ্ছে স্কী। হারবিন স্কী করার এক ভালো জায়গাও বটে। হারবিনে অনেক স্কী মাঠ আছে। এর মধ্যে ইয়াবুলি স্কী মাঠ সবচেয়ে বিখ্যাত এবং চীনের বৃহত্তম স্কী মাঠ। সেখানকার সর্বোচ্চ পর্বত সমুদ্রতল থেকে ১৩০০ মিটার উচু। গড়পড়তা তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। প্রতি বছরের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে পরের বছরের মার্চ মাসের শেষ দিক পর্যন্ত স্কী করার শ্রেষ্ঠ সময়।
বন্ধুরা, যেহেতু শীতকালে হারবিনের তাপমাত্রা খুব নিচু, সেহেতু সেখানে যাওয়ার আগে শীত প্রতিরোধের প্রচুর কাপড়চোপড়, টুপি ও দস্তানা প্রস্তুত করতেই হবে। পিছলানো রোধক জুতাও কিনতে হয়।
|