পাঁচ বছর আগে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগদান করে। তখন থেকে চীনের অর্থনীতি দ্রুত প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের সার্বিক আর্থ-সামাজিক বিকাশ অর্জিত হয়েছে। এখন চীন বিশ্বের তৃতীয় রপ্তানীকারী দেশ। দ্রুত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চীন অভূতপূর্ব উন্মুক্ত মনোভাব নিয়ে বিশ্ব বাজারের সঙ্গে মিশে গেছে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য বিরাট অবদান রেখেছে।
সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অন্তর্ভুক্তির পাঁচ বছর চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গড়পরতা অবদান হার ১৩ শতাংশ পৌঁছেছে। চীন বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তির অন্যতমে পরিণত হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের চীনা প্রতিনিধি কার্যালয়ের প্রধান দাভিদ দোলার সংবাদদাতাকে বলেছেন, "চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অন্তর্ভুক্তির পাঁচ বছরে বিশ্বের বাণিজ্যিক প্রবৃদ্ধিতে ২০ শতাংশ অবদান রেখেছে। চীন একটি বড় রপ্তানীকারী দেশ। আমদানী ক্ষেত্রে চীনের বৃদ্ধির হারও খুব দ্রুত। প্রতি বছর চীনের আমদানি ২৫ শতাংশ গতিতে বাড়ছে। চীন এশিয়া তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের একটি বড় বাজারে পরিণত হয়েছে।"
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অন্তর্ভুক্তির পর চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম মেনে নিয়ে নিজের প্রতিশ্রুতি পালন করে আসছে এবং বাণিজ্যিক ব্যবস্থা ও নীতির সার্বিক সুবিন্যস্ত করেছে। চীনের দ্রব্য বাণিজ্য বাজারের উন্মুক্ত মান লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চীনের গড়পরতা শুল্কের হার অন্তর্ভুক্তির সময়ের ১৫.৩ শতাংশ থেকে নেমে ২০০৫ সালের ৯.৯ শতাংশ হয়েছে। পরিসেবা বাণিজ্যও ধাপে ধাপে উন্মুক্ত হয়েছে। মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের আইন প্রয়োগের মাত্রা অনেক জোরদার হয়েছে। এর পাশাপাশি চীন বিদেশী পুঁজি আইন, বৈদেশিক বাণিজ্য আইনসহ অনেক আইন ও নিয়মকানুন প্রণয়ন করেছে। ২ হাজারটিরও বেশি আইন, প্রশাসনিক নিয়ম সংশোধন বা বাতিল করা হয়েছে।
মটোরোলা চীনা ইলেক্ট্রোনিক লিমিটেড কোম্পানির প্রেসিডেন্ট কাও রুই বিন মনে করেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অন্তর্ভুক্তির পর চীনের আইন, নিয়মকানুন ও নীতির স্বচ্ছতা অনেক বেড়েছে। চীন বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যবস্থামূলক নিশ্চয়তা দিয়েছে। তিনি বলেছেন, "চীনের বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারী বিভাগের দায়িত্বের পরিবর্তন ও পরিসেবা সচেতনতার উন্নতি এবং আইনের স্বচ্ছতা বাড়ানোসহ নানা ব্যবস্থায় চীনের পুঁজি বিনিয়োগ পরিবেশের আকর্ষণী শক্তি বেড়েছে।"
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অন্তর্ভুক্তির পাঁচ বছরে চীনের কর্মকর্তারা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ধাপে ধাপে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক নিয়ম দিয়ে নিজেকে সুরক্ষার সচেতনতা ও সামর্থ্য অবিরাম উন্নত করেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উদ্যোগে বাজার অর্থনীতির চিন্তাধারা ক্রমে ক্রমে চীনে সকলের অভিন্ন উপলদ্ধি হয়েছে। বিশ্বে প্রচলিত কিছু মৌলিক নিয়ম এখানে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রী বো সি লাই বলেছেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অন্তর্ভুক্তির পাঁচ বছরে চীনের বাজার ব্যবস্থার পুনর্নিমাণ, অর্থনৈতিক কাঠামোর পুনর্গঠনসহ সব ক্ষেত্রেই বিরাট অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের সার্বিক গুণের উন্নতি আরো লক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, "আমরা বিবেচনা করতে পারি যে, এ পাঁচ বছর চীনাদের আইন প্রশাসনের সচেতনতা, চীনাদের কর্মসংস্থানের চিন্তাভাবনা, চীনের মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের ধারণা এবং নিজের অধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে কত অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে? চীনা শিল্পপতিদের নবায়ন ও উদ্ভাবনের সচেতনতা, উন্নয়নের সচেতনতা, দুনিয়ার দৃষ্টিতে নিজের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মসূচী প্রণয়নের সচেতনতার দিকে কত অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে?"
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অন্তর্ভুক্তির পর চীনের জাতীয় অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধির প্রবণতা বজায় রেখেছে। চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনের জি ডি পি ২০০১ সালের ৯৫.৯ কোটি ইউয়ান রেনমিনপি থেকে বেড়ে ২০০৬ সালের প্রথম তিন কোয়ার্টারের ১৪১.৪ কোটি ইউয়ান হয়েছে। বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৯ শতাংশের বেশি।
আমদানির শুল্ক হার কমানো ও উত্পাদনশীলতার উন্নতির ফলে রঙিন টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশীন, ডিজিটাল ক্যামেরা প্রভৃতি পণ্যের দাম ধাপে ধাপে হ্রাস পেয়েছে। এটা সত্যি সত্যি চীনা জনসাধারণের জন্য বাস্তব কল্যাণ বয়ে এনেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের তৈরি গাড়ির দামও অনেক নেমেছে। নতুন গাড়ি প্রায়শই বের হয়। জীবনযাপনের মান উন্নয়নের দরুণ চীনা জনগণের ক্রয় শক্তি দ্রুত বেড়েছে। গাড়ি, পর্যটন, শিক্ষা, টেলিযোগাযোগের যন্ত্র, বাড়ি নতুন জনপ্রিয় পণ্যে পরিণত হয়েছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহা পরিচালক পাসকাল লামি মনে করেন, পাঁচ বছরে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নতুন সদস্যদের মধ্যে ভাল আদর্শ স্থাপন করেছে। তিনি বলেছেন, "বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগদানের পর চীনের ভূমিকার অত্যন্ত ভালো পয়েন্ট পাওয়া উচিত। চীন খুব ভাল করেছে। চীনকে ৯০ বা ১০০ পয়েন্ট দিতে পারি। এমন পয়েন্ট কেবল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অল্প সংখ্যক সদস্য পেতে পারে।"
চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগদানের অন্তর্বর্তীকাল পার হওয়ার পর নতুন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। এ সম্পর্কে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য বিভাগের পরিচালক চাং সিয়াং চেন বলেছেন,
"অন্তর্বর্তীকাল শেষ হওয়ার পর চীন আরো উন্মুক্ত অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজারে বিদেশী পণ্য ও বিদেশী পরিসেবার সঙ্গে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা করবে। এটা আমাদের জন্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ। কারণ বৈদেশিক উন্মুক্ততার পরিস্থিতি আরো জটিল হবে এবং আরো কঠোর হবে। আমাদের আরো কিছু নতুন সমস্যা মোকাবেলা করার সম্ভাবনা আছে। এটা আমাদের কাছে অপরিচিত।"
চীনের সমাজ বিজ্ঞান এ্যাকাডেমির বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতি গবেষণা কেন্দ্রের উপ-পরিচালক লি সিয়াং ইয়াং বলেছেন, একটি বড় বাণিজ্যিক দেশ হিসেবে ভবিষ্যতে চীনের উচিত বিশ্বের অর্থনীতির সুষ্ঠু উন্নয়নের জন্য আরো বিরাট অবদান রাখা এবং তার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক শক্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা।
|