মার্কিন বাহিনী ২৬ ডিসেম্বর ঘোষণা করেছে, আরো ছয় জন মার্কিন সৈন্য ইরাকে নিহত হয়েছে। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ শুরুর পর ইরাকে নিহত মার্কিন সৈন্য সংখ্যা ২৯৭৭ত দাঁড়িয়েছে । ২০০১ সালের "১১ সেপ্টেম্বর" টুহন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সংখ্যার চেয়ে চার জন বেশি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরাকের পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে মার্কিন বাহিনীর নিহতের সংখ্যা আরো বাড়বে। বুশ সরকার, মার্কিন সৈন্য বা মার্কিন জনসাধারণের কাছে এটা নিসন্দেহে এক গুরুতর ঘটনা।
অমীমাংসিত ইরাক যুদ্ধ ও ক্রমবধর্মান হতাহতের সংখ্যা মোকাবেলায় বুশ সরকার বিরাট চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে বুশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র বিরোধিতা উপেক্ষা করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে এড়িয়ে নিজেই তথাকথিত "সদিচ্ছা ইউনিয়ন" প্রতিষ্ঠা করে, ইরাকে হামলা চালিয়ে সাদ্দাম সরকারকে উত্খাত করেছে।
কিন্তু মার্কিন বাহিনী প্রায় ইরাকের প্রায় সব জায়গায় অনুসন্ধানের পরও " মারাত্মক অস্ত্র " খুঁজে পায় নি। বুশ সরকারের ইরাক যুদ্ধ বাঁধানোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে সাদ্দাম সরকার আর আল-কায়েদা সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কিন্তু এখন পর্যন্ত বুশ সরকার এ সম্পর্কিত কোন বাস্তব প্রমাণ পায় নি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী পার্টি ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এর তীব্র নিন্দা করেছে। তারা বলেন, ইরাক যুদ্ধ ও "১১ সেপ্টেম্বর" সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে সংযুক্ত করার কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই। ইরাক যুদ্ধ গুরুতরভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস দমনের শক্তি বিভক্ত করেছে। এর ফলে আল-কায়েদা সংস্থার নেতা ওসামা বিন লাদেন এখনো গ্রেফতার হয় নি। আফগানিস্তানের পরিস্থিতিও বিপদজনক।
যদিও বুশ সরকার এখনো দৃঢ়ভাবে বলছে যে, ইরাকে মার্কিন বাহিনী জয়লাভ করছে, অথবা জয়লাভ করবে । কিন্তু ইরাকে দিনে দিনে তীব্রতর হওয়া সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ও নানা বলপ্রয়োগ তত্পরতা মোকাবেলায় বুশ বাধ্য হয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী দোনাল্ড রামসফেল্ডকে পদচ্যুত করেছেন।
এরপর জাতীয় কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টির উদ্যোগে গঠিত "ইরাক সমস্যা গবেষণা গ্রুপের" এ মাসের প্রথম দিকে প্রকাশিত জরীপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরাকের পরিস্থিতি "অত্যন্ত গুরুতর এবং দিনে দিনে অবনতি হচ্ছে।" মার্কিন নতুন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রবার্ট গেটস জাতীয় সংসদে খোলাখুলিভাবে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ইরাক যুদ্ধে জয়ী হয় নি। নিষ্ঠুর বাস্তবতার সামনে বুশ বাধ্য হয়ে ১৮ ডিসেম্বর প্রথম বার স্বীকার করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে জয়লাভ করে নি। বুশ সরকার বিরাট চাপের মুখে রয়েছে। এমন কি মার্কিন তথ্য মাধ্যম জিজ্ঞাসা করছে যে, প্রেসিডেন্ট বুশ রাতে ঘুমাতে পারেন কি?
ব্যাপক মার্কিন জনসাধারণের দৃষ্টিতে ইরাক যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কি বয়ে এনেছে? ১৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক জরীপ অনুযায়ী, মার্কিন জনগণের বুশের ইরাক নীতির ওপর সমর্থনের হার নেমে ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে । বুশ সরকারের ইরাক নীতির বিরোধীতার হার ৭০ শতাংশ। এটি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।
অন্য একটি বিশ্লেষণ রিপোর্টে বলা হয়েছে, মার্কিনীরা ইরাক যুদ্ধের দুঃখ শিকার করছে। অধিকাংশ মার্কিনী মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক পরিত্যাগ করা উচিত নয়, তবে ইরাক যুদ্ধের ব্যয় অতি বেশি। তারা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইরাক থেকে সরে আসা উচিত। কিন্তু সেনা প্রত্যাহারের পর ইরাকে দাঙ্গাহাঙ্গামা আরও বাড়ার আশংকা রয়েছে । তাঁরা "ইরাক সমস্যা গবেষণা গ্রুপের" প্রস্তাব সমর্থন করেন, কিন্তু এই প্রস্তাবের নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর ওপর ভালো করে জানেন না। ফলে বলা যায় না, বুশ সরকার এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করবে কিনা।
ক্রমবধর্মান নিহতের সংখ্যা ইরাকে মোতায়েন মার্কিন সৈনিকদের মনে বড় চাপ ফেলেছে। ইরাকে মোতায়েন মার্কিন বাহিনীর সংশ্লিষ্ট বিভাগের সৈন্যদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে পরীক্ষা করার ফলাফল অনুযায়ী, ১৩.৬ শতাংশ মার্কিন সৈন্য অতিরিক্ত মানসিক চাপ বোধ করে। আত্মহত্যা ঘটনা প্রায়ই ঘটছে ।
আগামী মাসে বুশ সরকার নতুন ইরাক কৌশল প্রকাশ করবে। কিন্তু অনেক মার্কিন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইরাকের নীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোন ভালো বাছাই নেই, কেবল খারাপ বাছাই আছে। সুতরাং নীতি পরিবর্তন হলেও ভবিষ্যত সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী নয়।
|