পেইচিং একটি সূদীর্ঘ ঐতিহাসিক মহা নগর। এ শহরে বহু বিখ্যাত পর্যটন স্থান ছাড়াও রয়েছে অনেক প্রাচীন দোকান-পাট। আজ আমি আপনাদের নিয়ে পেইচিংয়ে সংরক্ষিত শত বছরের ইতিহাস সম্পন্ন পুরোনো দোকান দেখতে যাবো। এই দোকানগুলোর সোনালী ট্রেডমার্ক পেইচিং নগরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরিচয় দেয়া হয়।
পেইচিং শহরের পুরোনো ট্রেডমার্কের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ ইতিহাসসম্পন্ন একটি দোকান হচ্ছে তোরেনথাং। এ ঔষধের দোকানটি ১৬৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তোরেনথাংকে পেইচিংয়ের পুরোনো দোকানগুলোর প্রতিনিধি বলা হয়।
তোরেনথাং ঔষধের দোকানের প্রতিষ্ঠাতার নাম ইয়ু সিয়ান ইয়াং। তিনি তত্কালীণ সম্রাটের এক জন উচ্চপদস্থ চিকিত্সক ছিলেন। তিনি ঔষধ তৈরির সময় সবসময় শ্রেষ্ঠ কাচামাল বেছে নিতেন, কড়াকড়িভাবে নিয়ম অনুসারে ঔষধ তৈরির প্রক্রিয়া মেনে চলতেন এবং রাজপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় তাঁর তোরেনথাং ঔষধের দোকান পেইচিংয়ের একমাত্র রাজপরিবারের ঔষধ সরবরাহকারী দোকানে পরিণত হয়েছিল। তোরেনথাং ঔষধের দোকানে বহু বছর ধরে কর্মরত কিন ইয়ো নিয়েন জানিয়েছেন, তোরেনথাংয়ের অধিকাংশ ঔষধপত্র রাজপ্রাসাদ থেকে পেয়েছে। তিনি বলেছেন, "যেমন তোরেনথাংয়ের কুওকোং মদ হচ্ছে ১৪ শতাব্দীতে মিং রাজবংশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সংগৃহীত ব্যক্তিগত ঔষধপত্র। এই মদ পাওয়ার পর তিনি নিজের বাসায় মদ তৈরি করলেন, এ মদের চিকিত্সা ভূমিকা আছে। এরপর এ ঔষধপত্র রাজপরিবারের হাসপাতালে গেছে। তোরেনথাংয়ের চিকিত্সকরা এ ঔষধপত্র নিয়ে বহু গবেষণা করার পর এর গুণগত মান আরো বেড়ে যায়। পরে ছিং রাজবংশের শেষ বিধবা রাজমাতা ছিশি এ মদ খেয়েছেন। এখন কুওকোং মদ তোরেনথাংয়ের একটি অত্যন্ত নামকরা এবং ঐতিহ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে।"
কিন ইয়োং নিয়েন বলেছেন, তোরেনথাং ঔষধের দোকান শুধু ঔষধ বিক্রি করা হয় তাই নয়, দোকানটি চীনা ঔষধ তৈরির জন্য বিখ্যাত। এখানে ঔধষ তৈরির ধারাবাহিক নিয়মকানুন আছে। গত ৩০০ বছর তোরেনথাংয়ের কর্মীরা সবসময় এই ঐতিহ্য অনুসারে আন্তরিকতার সঙ্গে প্রতিটি ঔষধ উত্পাদন করেন। তিনি আরো বলেছেন, "আমি এক উদাহরণ বলি। বাচ্চাদের উচ্চ তাপমাত্রা কমানোর জন্য এক রকম বিখ্যাত চীনা ঔষধ চিসুয়েসান। এটা প্রাচীনকালের একটি ঔষধ। এ ঔষধ উত্পাদানের সময় সোনালী পাত্র ও রুপালী বেলচা ব্যবহার করা হয়। সাধারণ ঔষধ উত্পাদনকারীরা এসবে গুরুত্ব দেন না। কিন্তু তোরেনথাংয়ের চিকিত্সকরা মনে করে, যেহেতু প্রাচীন ঔষধপত্র সোনালী পাত্র ও রুপালী বেলচা ব্যবহার করে তৈরী করা হতো, সেহেতু এ ঔষধ তৈরীর প্রক্রিয়ায় সোনা অবশ্যই কোন উপাদানের বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তোরেনথাংয়ে এমন বড় সোনালী পাত্র নেই, তবে তোরেনথাংয়ের তত্কালীণ কর্মীরা ৫ কেজি সোনালী অলংকার সংগ্রহ করেন। চিসুয়েসান উত্পাদনের সময় এই সোনালী অলংকার ঔষধগুলোর সঙ্গে থাকে। এ ঐতিহ্য কয়েক শ বছর ধরে বজায় রয়েছে।"
এখন তোরেনথাং কেবল মাত্র একটি ঔষধের দোকান নয়, বরং চীনের ঐতিহ্যিক চিকিত্সা ও ঔষধ সংস্কৃতির প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছে। কিছু দিন আগে, তোরেনথাংয়ের ঔষধপত্র এবং ঔষধ তৈরির প্রযুক্তি চীনের প্রথম অবাস্তব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। যদি আপনি কখনো পেইচিংয়ে আসেন, তোরেনথাং ঔষধের দোকানে এসে এখানকার কিছু স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য নামকরা ঔষধ যেমন জিনসেন কিনতে পারেন। সময় থাকলে আপনার স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সেখানের ডক্টরের কাছে গিয়ে কিছু পরামর্শ শুনুন। উপকার পাবেন।
পেইচিংয়ের পুরোনো দোকানের কথা বললে "চাং ই ইউয়েন" নামে একটি চা পাতার দোকানের নাম এড়ানো যায় না। এ চা পাতার দোকানের ইতিহাস ১০০ বছরের বেশি। "চাং ই ইউয়েনের" সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় পণ্য হচ্ছে জ্যাসমিন চা। জ্যাসমিন চার পানি পরিষ্কার, মুখে দিলে গভীর সুগন্ধ চলে আসে। এ দোকানের দায়িত্বশীল ব্যক্তি লিউ চিয়া বো জানিয়েছেন, "জ্যাসমিন চা সবুজ চা ও জ্যাসমিন ফুল দিয়ে তৈরি। সবুজ চা তৈরীতে বসন্তকালের চা পাতা বেছে নিতে হয়। জ্যাসমিন ফুল গ্রীষ্মকালে সংগ্রহ করতে হবে। কারণ যত গরম পড়ে , জ্যাসমিন ফুলের সুগন্ধ তত তীব্র হয়। জ্যাসমিন ফুল সম্পূর্ণ ফুটলে হবে না, কারণ ফুল সম্পূর্ণ ফুটলে আর সুগন্ধ থাকবে না।"
জ্যাসমিন চা ছাড়া "চাং ই ইউয়েন" দোকানে আপনি চীনের নানা রকম ঐতিহ্যিক চা আর চমত্কার চা পাত্র কিনতে পারেন। ক্লান্ত হলে আপনি সেখানে বসে এক কাপ জ্যাসমিন চা খেতে পারেন। দোকানদারের কাছ থেকে চা সম্বন্ধে কিছু কাহিনী শুনতে পারেন অথবা চীনের ঐতিহ্যিক চা শিল্পের পরিবেশনা উপভোগ করতে পারেন।
১৯ শতাব্দীর শেষ দিকে মাং নামে একজন ব্যবসায়ী ৮০০০ কেজি লিয়াং রূপা পুঁজি বিনিয়োগ করে রুইফুসিয়াং প্রতিষ্ঠা করেন। এই দোকানটির ভবন চীন আর ইউরোপের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এটিকে পেইচিংয়ের পুরাকীর্তি সুরক্ষা ইউনিটের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। জানা গেছে, ১৯০০ সালে এই দোকানটির অবস্থান দাশিলা সড়কে একবার গুরুতর অগ্নিকান্ড ঘটে। তখন অনেক দোকাট-পাট ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্ত রুইফুসিয়াংয়ের স্থাপত্য অত্যন্ত মজবুত বলে কোন ক্ষতি হয় নি।
এখন রুইফুসিয়াং চীনা পোষাক তৈরি এবং নানা রকমের রেশম কেনার প্রথম স্থান। জানা গেছে, নয়া চীনের প্রথম জাতীয় পতাকা এই দোকানের উত্পাদিত রেশম দিয়ে তৈরি। রুইফুসিয়াং বিদেশেও নাম ছড়িয়েছে। দোকানদার জানিয়েছেন, অনেক দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের স্ত্রী চীন সফরকালে এখানে এসে রেশম কিনেন। মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্রাইট চীন সফরকালে বিশেষ করে অর্ধ দিন সময় নিয়ে এখানে এসে কয় হাজার ইউয়েন রেনমিনপি মূল্যের রেশম কিনেছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ম্যাডাম সেটসুকো চেম্বারস বলেছেন, "আগে আমি একটি বইতে এ দোকানের কথা পড়েছি। সেই জন্য আমি এখানে এসে কিছু রেশম কিনেছি। এসব পণ্য মার্কিনীদের কাছে বিশিষ্ট্যসম্পন্ন। এ অভিজ্ঞতা আমার জন্য সত্যি উত্তেজনাময়।"
পেইচিংয়ের দাশিলাই সড়কে সবচেয়ে বেশি পুরোনো দোকান রয়েছে। উপরোল্লেখিত কয়েকটি দোকান ছাড়া , আরো আছে নেইলাইনশাং জুতার দোকান, উ ইয়ু থাই চায়ের দোকানসহ কয়েকটি বিখ্যাত দোকান। আপনি চীনে আসলে অবশ্যই এখানে আসবেন। টিয়ান আন মেন মহাচত্বরের দক্ষিণ দিকে হেটে হেটে মাত্র দশ মিনিটে দাশিলাই ব্যবসা সড়কে পৌঁছা যায়।
|