পামির মালভূমিতে বসবাসকারী তাজিকিস্তান জাতীয়রা মনে করেন যে, তারা সূর্যের সবচেয়ে নিকটে বসবাস করে থাকেন । তাদের বিয়ের রীতিনীতি যেমন রহস্যপূর্ণ তেমনি বৈচিত্রময়। তাজিকিস্তান জাতির মেয়ে পালিমার বয়স ১৩ বছর । মা তাকে সঙ্গে নিয়ে তাসকুর্গানের তাহমান জেলায় খালার বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যান । তাহমান জেলা বিখ্যাত মুস্তাগ শৃঙগের তলদেশে এবং তাসকুর্গান জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । তাজিকিস্তান জাতির বিয়ের অনুষ্ঠান সাধারণত শরত্কালে হয় । শরত্কালের আবহাওয়া ভাল , গরু ও ছাগল হৃষ্টপুষ্ট হয় । তাই অক্টোবর মাসে তাদের বিয়ে করার এক চমত্কার সময় । জেলা থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেক দিনই বিয়ের অনুষ্ঠান হয় ।
তাজিকিস্তান জাতির রীতি অনুযায়ী বিয়ের অনুষ্ঠানের আগের কয়েক দিন বর ও কন্যা দুপক্ষকেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট পরিবারে গিয়ে তাদের মতামত শুনতে হবে এবং তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে আন্তরিকভাবে আপ্যায়িত করতে হবে । তাদের প্রতি নিজদের সম্মান প্রদর্শন করে নিজেদের আশা প্রকাশ করতে হবে যে , আসন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে তারা অশ্রু মুছে যেন নতুন স্বামীস্ত্রীকে আশির্বাদ করবেন । যখন অতিথিরা ঢাকঢোল বাজাতে রাজী হন তখন বিয়ের অনুষ্ঠানে আমোদপ্রমোদ শুরু হয়ে যায় । পালিমা ও তার মা নানির বাড়িতে যখন পৌঁছুলে তখন গোটা গ্রাম উত্সবের আনন্দে নিমজ্জিত ।
সাধারণত তাজিকিস্তান জাতি চুমু খেয়ে পরস্পরকে সালাম জানান । বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রথম কয়েক দিনে পালিমার দূরের অতিথিরা নান রুটি , কাপড়, অলংকার বা ছাগল নিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে আসেন । তাজিকিস্তান জাতির বিযের অনুষ্ঠান সাধারণত তিনদিন চলতে থাকে । কিন্তু কন্যার পরিবারে বিয়ের অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় । এ সময় পালিমার খালা বাইরের কোনো লোকের সঙ্গে দেখা করতে পারেন না । তাঁকে ছোট্টো একটি ঘরে লুকিয়ে থাকতে হবে । খাওয়ার সময়ে বাবা মা তার জন্যে খাবার নিয়ে আসবেন । বিয়ের অনুষ্ঠানে তার পরার কাপড় ও গহনা সবই তার বড় বোন তার জন্য প্রস্তুত করেন ।
পালিমার নানির বাড়ির সামনে একটি বিরাট আকারের তৃণ ক্ষেত এবং একটি ছোটো নদী আছে । খালার শ্বশুর বাড়ি তৃণ ক্ষেতের ওপাশে । রীতি অনুযায়ী বিয়ের অনুষ্ঠানের আগে তাদের বাড়িতে বেশ কয়েক দিন ধরে ছাগল ধরার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় ।
ছাগল ধরা খেলাটা অশ্ব শক্তি ও মানব শক্তি সমন্বয় করে চালানো এক প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ বিনোদন তত্পরতা ।তত্পরতাটি সাধারণত উত্সব বা বিয়ের অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয় । সর্বপ্রথমে এক প্রবীণ বৃদ্ধ শির কাটা ছাগল মাটিতে রেখে দেন । তার পর নির্দেশানুযায়ী অশ্বারোহীরা ছাগল নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করেন । অবশেষে যে অশ্বারোহী ছাগল তুলে নিতে পারেন তিনিই বিজয়ী হন ।
বিয়ের অনুষ্ঠানের আগের দিন রাতে চারদিকের আত্মীয় স্বজনরা নাচ করতে আসবেন । মাত্র ৩০ হাজার লোক বিশিষ্ট তাজিকিস্তান জাতির সবাই নাচতে পারে । পামির মালভূমিতে বসবাসকারী তাজিকিস্তান জাতি ও ইগলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে । তাদের মতে ইগল কল্যাণকর পাখী । তারা ইগলকে তাজিকিস্তান জাতির প্রতীক হিসেবে মেনে চলে। ইগল তাদের নাচ ও সঙ্গীতের উত্স । ইগল- সংস্কৃতি তাজিকিস্তান জাতির আত্মায় আত্মীয় । তাই তাদের নাচ ঐতিহ্যিক ইগল নাচের ভিত্তিতে তৈরী । বিয়ের অনুষ্ঠানে ইগল বাঁশি বাজাতে হবে এবং ইগল নাচ করতে হবে ।
ইগল বাঁশি ও ইগল নাচ সম্পর্কে এক মর্ম স্পর্শী কাহিনী আছে । অনেক অনেক দিন আগে তাজিকিস্তান জাতির দুজন প্রেমিক-প্রমিকা ছিল । তারা পরস্পরকে অত্যন্ত ভালবাসতো । কিন্তু হিংসাত্মক জমিদার জোর করে তাদের পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে । ফলে মেয়ে পাহাড়ী ইগলে পরিণত হলেও জমিদার তীর ছুড়ে নিষ্ঠুরভাবে তাকে মেরে ফেলল । মেয়েটি স্বপ্নের মাধ্যমে প্রেমিককে মরা পাহাড়ী ইগলের পাখার হাড় দিয়ে বাঁশি তৈরী করতে বললেন । এর পর থেকে ইগল- বাঁশির সুর ও অবাধ উড্ডয়নের ইগল নাচ প্রেমের প্রতীকে পরিণত হয় ।
বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন সকালে বরের বাড়িতে গ্রামবাসীরা সবাই সমবেত হন । বরের কাপড়চোপড় সর্বপ্রথমে ইমাম ও সকলের প্রার্থিত হতে হবে এবং এর উপরে আশির্বাদসম্পন্ন কিছু ময়দা ছড়িয়ে দিতে হবে । তারপর বর এই কাপড়চোপড় গায়ে পরে নেবেন । এই সময় বিয়ের অনুষ্ঠানের অশুভ দিক দূর করার জন্যে বর পক্ষকে একটি ছাগল জবাই করতে হবে । এটাও কন্যার জন্য প্রস্তুত প্রথম মাংস খাবার ।
জাতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কাপড়চোপড় পরা ছাড়াও বরের মাথায় লাল ও সাদা রঙের ফিতা লাগাতে হবে । এটাই বরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন । কাপড়চোপড় পরার পর বরের মা ছেলের কাপড়ে ময়দা ছড়িয়ে তার শুভকামনা করেন । বরযাত্রা শুরু হল । কন্যার বাড়িতে এসে কনের মা বর এবং তার সহযাত্রীদের গায়ে কিছু ময়দা ছড়িয়ে স্বাগত ও শুভকামনা করেন ।
পালিমার খালার চুলে চারটি বেণী করা হয় এবং বিয়ের চিহ্ন হিসেবে বেণীতে কিছু বোতাম লাগানো হয় । কন্যার কাপড় ইমামের আশির্বাদ ও পরিবারপরিজনদের প্রার্থিত হলেই কেবল কন্যা গায়ে পরতে পারবে । কন্যার যৌতুকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হল ঘোমটা । বরের বাড়িতে তিন দিন থাকার পর ঘোমটা খোলা যায় ।এছাড়া কন্যাকে সাদা ও লাল রঙের ফিতা লাগানো আংটি পরতে হয় । তাজিকিস্তান জাতির প্রত্যেক কন্যাকে বিয়ের আগে নিজের প্রিয়তমের জন্যে একটি রুমাল সেলাই করে উপহার দিতে হবে । কন্যার বাবা মা লবন মিশানো পানি বর ও কন্যাকে খেতে দেন । তারপর পরিবারপরিজনরা আবার ময়দা ছড়িয়ে বর-কন্যাকে আশির্বাদ করেন । পালিমার খালা কেঁদেকেঁদে আতিয়স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিয়ের গাড়িতে ওঠেন । বর পক্ষ কন্যার বাড়ির বাটি চুরি করে নেয় । এটা একটা আঞ্চলিক রীতি ও বিয়ের অনুষ্ঠানের একটি খেলা ।
নিজের মেয়ের কথা সবসময় বাবা মার মনে পড়ে তা প্রমাণ করার জন্যে বিয়ের অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিন স্থানীয় রীতি অনুযায়ী পালিমা নানা নানির পক্ষ থেকে খালাকে ভাত ও তরকারি দিতে যায় । কন্যার জন্যে এটা বাবা-মার শেষ রান্না । এই রান্না বাবা মার শুভকামনায় ভরপুর । বরের পরিবার কন্যার পরিবারকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু উপহার দেয় । গোটা অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর খালা তার ঘোমটা উঠিয়ে দেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর সুখী পারিবারিক জীবন শুরু করেন ।
|