চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী লাসায় ছেই ছুয়ান নামে একটি বিকলাঙ্গ স্কুল আছে । স্কুল থেকে একটির পর একটি সুন্দর গানের সুর ভেসে আসছিল । আসলে এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা হাতে হাত মিলিয়ে তাদের স্কুলের গান গাইছিল । বাচ্চাদের মধুর কন্ঠস্বর স্কুলের ক্যাম্পাস ছড়িয়ে বাইরেও ভেসে উঠলো । লাসা শহরে শরত্কালের অনন্য লাবণ্য ফুটে উঠে ।
লাসা শহরের এই স্কুল বিশেষ করে বিকলাঙ্গ ও অনাথদের জন্য স্থাপন করা হয়েছে । স্কুলের পরিচালকের নাম চম্পা সোন্দ্রে । তিনিও লাসা শহরের একটি সংখ্যালঘু জাতির হস্তশিল্প দ্রব্য কারখানার প্রধান । চম্পা সোন্দ্রে লম্বা নন , দেখতে আন্তরিক ও উদার । পুরানো তিব্বতের অনেক দরিদ্র বাচ্চাদের মতো চম্পা সোন্দ্রে কখনো নিয়মিত স্কুলে পড়েন নি । তিনি শুধু কয়েক বছর তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের শাস্ত্রীয় পুথি পড়েছেন । বড় হওয়ার পর তিনি কাঠ ও জুতার মিস্ত্রীর কাজ এমন কি অভিনেতার কাজও করেছেন ।
বহু বছর ধরে চাকরি করার পর ১৯৮৬ সালে চম্পা সোন্দ্রে লাসা শহরের একটি জুতা কারখানার প্রধান হন । তিনি লক্ষ্য করেছেন , বেশ কিছু অনাথ ও বিকলাঙ্গ শিশু স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ পায় না । কিছু কিছু বিকলাঙ্গ যুবক কর্মসংস্থান করতে পারে না । তাদের জীবনযাপনের কোন নিশ্চয়তা নেই । বার বার বিবেচনা করার পর তিনি এ সব অনাথ ও বিকলাঙ্গের জন্য লেখাপড়া ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন ।
চম্পা সোন্দ্রে তার জুতা কারখানাকে সংখ্যালঘু জাতির বিকলাঙ্গদের হস্তশিল্প দ্রব্য কারখানায় পরিণত করেন । বিশ জনেরও বেশি বিকলাঙ্গ যুবক ও অনাথ তার কারখানায় ভর্তি হন । কারখানায় তারা লেখাপড়া করেছেন এবং চিত্রাঙ্গন , ভাস্কর্য , জুতা তৈরী প্রভৃতি কলাকৌশল শিখেছেন । সুতরাং তাদের কর্মসংস্থান ও সংসারের কোন চিন্তা নেই ।
১৯৯৩ সালে চম্পা সোন্দ্রে বহু বছর ধরে তার কর্মপ্রচেষ্টায় জমা রাখা ৪ লাখেরও বেশি অর্থ ব্যবহার করে ছেই ছুয়ান নামে অনাথ ও বিকলাঙ্গ শিশু স্কুল গড়ে তোলেন । তিনি এই স্কুলের প্রধান হয়েছেন ।
এ সব অনাথ ও অত্যন্ত দরিদ্র শিশুদের জন্য চম্পা সোন্দ্রে তাদের খাওয়া , থাকা ও লেখাপড়ায় প্রয়োজনীয় যাবতীয় খরচ বহন করেছেন । এর সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররা তিব্বতী চিত্রাঙ্গন, জাতীয় পোষাক বানানো , তিব্বতী কাগজে কাটা , কাঠের ভাস্কর্য প্রভৃতি ঐতিহ্যিক হস্তশিল্প দ্রব্য তৈরীর বিশেষ প্রযুক্তিও শিখেছে । চম্পা সোন্দ্রে বলেছেন , ছাত্ররা সমাজের জন্য যাতে যোগ্য কর্মীতে পরিণত হয় , সেজন্য তিনি যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন ।
পুরানো তিব্বতে অনাথ ও বিকলাঙ্গ শিশুরা খুব দারিদ্র্য ও দুঃখ-কষ্টে থাকতো । কেউই তাদের দেখাশুনা করতো না । এখন অনাথ ও বিকলাঙ্গসহ সকল তিব্বতীরা সুখী জীবনযাপন করছেন । অনার্থ ও বিকলাঙ্গ শিশুদের নতুন সমাজের প্রতি ধন্যবাদ জানাতে হবে এবং মাতৃভূমির সমৃদ্ধির জন্য ভালভাবে লেখাপড়া করতে হবে । চম্পা সোন্দ্রের শিক্ষায় ছাত্ররা একাগ্রচিত্তে লেখাপড়া করছে । ছেই ছুয়ান স্কুল থেকে পাস করা ছাত্ররা নানা রকমের ভাল স্কুলে ভর্তি হয়েছে ।
এখন ছেই ছুয়ান অনাথ ও বিকলাঙ্গ স্কুলে মোট ১৪৫ জন ছাত্রছাত্রী আছে । চম্পা সোন্দ্রে নিজের বাচ্চাদের মতো এ সব ছাত্রকে আদর ও দেখাশুনা করছেন । বাচ্চারা তাকে কখনো স্কুলের প্রধান ডাকে না , বরং বাবা ডাকে । অনাথ ড্রোজে সেতেন তার একজন ছাত্র । ছোট বেলায় তার বাবা মারা গেছেন । ছ'বছর বয়সে তার মাও হঠাত্ মৃত্যু বরণ করেছেন । সেই স্মৃতি করে ড্রোজে বলেছে ,
তার চোখে এই স্কুল একটি স্নেহপূর্ণ বড় পরিবার বলে মনে করা হয় । এই পরিবারে তার বহু ভাই বোন আছে । তার খাওয়া ও থাকার কোন সমস্যা নেই । সে প্রথম বারের মতো পরিপূর্ণ ক্লাসরুমে প্রবেশ করেছে , শিক্ষককে দেখেছে এবং নতুন পাঠ্যপুস্তক পেয়েছে । সেও প্রথম বারের মতো শুনেছে তার মাতৃভূমির নাম চীন । ছ'মাস ধরে সে ছেই ছুয়ান স্কুলে থাকছে । সে ও তার সহপাঠীরা খুব সুখী জীবনযাপন করছে । তারা বেশি জ্ঞান অর্জন করেছে ।
চম্পা সোন্দ্রের দাতব্য কর্মসূচী স্তানীয় সরকারের সমর্থন পেয়েছে । বাচ্চাদের চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় সরকার প্রত্যেক বাচ্চাকে মাসে ২ শো ইউয়ান ভর্তুকী দেয় । বাচ্চারা রোগে আক্রান্ত হলে যথাসময় ও যথাযোগ্য চিকিত্সা গ্রহণ করতে পারে ।
চম্পা সোন্দ্রের মর্মস্পর্শী কর্মসূচী স্কুলের বহু শিক্ষককে আকর্ষণ করেছে । বেশ কিছু শিক্ষক ছেই ছুয়ান স্কুলে পড়াতে ইচ্ছুক । তারা আরো বেশি অনাথ ও বিকলাঙ্গ শিশুদের জন্য জ্ঞান ও স্নেহ বয়ে আনতে চান । মাদাম ডেকি ঝোলমা তাদের মধ্যে একজন । তিনি এই স্কুলে এসেছেন শুধু এক বছর হল । তিনি পড়াতে খুব পছন্দ করেন ।
তিনি পড়ানোর কাজে নিয়োজিত আছেন দশ বছর ধরে । তিনি মনে করেন , অন্যান্য স্কুলের চেয়ে এখানের পড়ানোর কাজ ভিন্ন । এখানের বিকলাঙ্গ ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ কালা , কেউ কেউ অন্ধ আর কেউ কেউ অনাথ । কারো কারো বয়স দশ বছর । কিন্তু তারা কখনো স্কুলে লেখাপড়া করে নি । এ সব বাচ্চা অধ্যবসায়ের সঙ্গে লেখাপড়া করছে । যখন তিনি স্কুলের প্রধানের স্নেহ ও মায়া-মমতা অনুভব করেন , তখন তিনি খুব মুগ্ধ হন । তিনি মনে করেন যে , এই স্কুলে পড়ানোর কাজ করা তার জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব । ছেই ছুয়ান স্কুল আরো ভালভাবে চালানোর জন্য তিনি সর্ব শক্তি নিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
বিকলাঙ্গ ও অনাথদের আরো বেশি যত্ন ও স্নেহ করা দরকার । তাদের পড়ানোর ব্যাপারে চম্পা সোন্দ্রে নিরন্তরভাবে চীনের অভ্যন্তরস্থলের বিকলাঙ্গ স্কুলের উন্নত মানের শিক্ষা পদ্ধতি ও অভিজ্ঞতা শিখেছেন এবং তিব্বতের স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা পদ্ধতি গড়ে তুলেছেন । ছাত্রদের লেখাপড়ার ভিন্ন সামর্থ্য অনুযায়ী তিনি ভিন্ন পড়ানোর কার্যক্রম প্রণয়ন করেছেন । এতে ছাত্রদের শেখার আগ্রহ বেড়েছে এবং পড়ানোর মানও ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে ।
লাসা শহরের ছেই ছুয়ান বিকলাঙ্গ স্কুল গড়ে উঠেছে দশ বারো বছর হল । বহু ছাত্র এই স্কুল থেকে পাস করার পর চীনের অভ্যন্তরস্থলের উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন ।
|