শরত্কালের প্রথম দিকের কোন এক দিন ভোরে উষ্ণ সূর্যরশ্মি নিঃশব্দে অরণ্যের উপরে ছড়িয়ে পড়েছে । চারি দিক শান্তিময় নীরবতায় নিমগ্ন । ঘন্টার টুংটাং আওয়াজে সংবাদদাতার দৃষ্টি গভীর অরণ্যের ভেতরে চলে যায় । তিনি দেখতে পান এক দল হরিণ উত্ফুল্লতার সঙ্গে পাহাড়ী পথের পাশের একটি তাবুর দিকে ছুটে যাচ্ছে । তাবুর ভিতর থেকে মালুশা নামে একজন গৃহকর্ত্রী বেরিয়ে এলেন । ৩০ টিরও বেশি হরিণ তার চার দিক ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে । হরিণগুলোর মধ্যে কোন কোনই আনন্দ আর আহ্লাদে তার গায়ে ঘেঁষল । তিনি তাদের খুব আদর করলেন এবং তাদের স্নিগ্ধভাবে স্পর্শ করলেন । গৃহকর্ত্রীর নির্দেশে তারা নিঃশব্দে তাবুর দু'পাশে শুয়ে থাকল যেন আপন ইচ্ছেতেই ।
এই ক্যানভ্যাসের তাবু মালুয়ার সাময়িক বাসা । তাবু বড় নয় , ভিতরে তিনটি কাঠের বিছানা ছাড়া বাকী জায়গায় শুধু একটি লোহার উনুনে রান্নার ব্যবস্থা করা হচ্ছিল । সংবাদদাতাকে গরম করার জন্য অন্তরঙ্গভাবেই উনুনের আঁচ বাড়াতে স্বাগতিক উনুনের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানী বন্দোবস্ত করেছেন । তাবু শান্ত ও উষ্ণ পরিবেশে আচ্ছন্ন ।
চীনের অন্তঃমঙ্গোলিয়ায় অবস্থিত ঔ ওয়েন ক্ জাতি অধ্যুষিত এই থানার আশাপাশে নিবিড় অরণ্য বেষ্টিত । মালুয়ার স্বামী গৃহকর্তা আরোংপুর বয়স ৫৭ । উদার ও স্বাস্থ্যবান এই গৃহকর্তা প্রফুল্লচিত্তে সংবাদদাতাকে বলেন যে , ঔ ওয়েন ক্ জাতির লোকেরা যুগ যুগ ধরে হরিণ পালন করে আসছেন । হরিণকে তাদের পরিবার পরিজন বলে গণ্য করা হয় ।
ঔ ওয়েন ক্ জাতির লোকদের জীবনধারা হরিণ পালন থেকে বিছিন্ন করা প্রায় অসম্ভব । হরিণ পালনের এই জীবন ছাড়া এই জাতির অস্তিত্বের যেন কোনো অর্থ নেই ।
ঔ ওয়েন ক্ জাতি চীনের কম লোকসংখ্যার একটি জাতি । তাদের সংখ্যা মাত্র ৩০ হাজার । তারা প্রধানতঃ অন্তঃমঙ্গোলিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ও উত্তর- পূর্ব চীনের হেইলুংচিয়াং প্রদেশ সংলগ্ন অঞ্চলের বিভিন্ন অবস্থিত অরণ্যে বসবাস করে । আরোংপু ও তার পরিবার পরিজনের বসবাসকারী আওলুকুয়া থানার লোকসংখ্যা দু'শোর একটু বেশি । আগে ঔ ওয়েন ক্ জাতির লোকেরা প্রধানতঃ পশু শিকার ও হরিণ পালন করে জীবনযাপন করতেন । তাদের জাতির নাম ' ঔ ওয়েন ক্'-এর অর্থ পাহাড়ে বসবাসকারী অধিবাসী । ৫০ বছর আগে ঔ ওয়েন ক্ জাতির মানুষ চিরস্থায়ী আবাসন নির্মাণ করতে শুরু করলেন । তিন বছর আগে আরোংপু ও অন্যান্য গ্রামবাসী তাদের শিকার জীবন ছেড়ে শহরের উপকন্ঠে স্থানান্তরিত হয়েছেন ।
কিন্তু অরণ্যে আরোংপু ও তার স্ত্রীর সঙ্গে সংবাদদাতার দেখা হল । এটা কি সের জন্য? কারণ হরিণ গৃহ পালিত হওয়ার পর তাদের হজমের ক্ষমতা বলতে গেলে দুর্বল হয়ে পড়েছে । তারা এমন কি বন্য সবজিও এখন খেতে পছন্দ করে না । বেশ কিছু হরিণ রোগাক্রান্ত হয়েছে । তাই নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে হরিণদের আদর ও তাদের দেখাশুনা করার জন্য আরোংপু ও তার স্ত্রী অরণ্যে ফিরে গিয়েছেন ।
আরোংপু সংবাদদাতাকে বলেছেন , পাহাড়ের পাদদেশের চেয়ে উপরের দিক অনেক অনুন্নত । থানা সরকার পাহাড়ের পাদদেশে ঔ ওয়েন ক্ জাতির শিকারীদের জন্য নতুন আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে । নতুন বাড়িগুলো নানাবিধ ইলেকট্রোনিক্স দ্রব্যেও সজ্জিত করা হয়েছে । সরকার তাদের চিকিত্সা বীমার অগ্রাধিকারও দিয়েছে ।
সংবাদদাতা আরোংপুর সঙ্গে পাহাড়ের পাদদেশে তার বাড়িতে গেলেন । বাড়ি ইট দিয়ে নির্মিত । হাল্কা লাল রঙ করা হয়েছে । ঘর বড় ও পরিপাটি । ঘরের পরিচ্ছন্ন সাদা রঙের দেয়ালে বেশ কিছু পুরানো আলোকচিত্র টাঙ্গানো । তিনি বলেছেন , তিনি পাহাড়ে থাকতে অভ্যস্ত হয়েছেন । পাহাড়ের নীচের নতুন বাড়ি যদিও আরামদায়ক , কিন্তু তিনি পাহাড়ের উপরের জীবনধারা পছন্দ করেন । তিনি একজন দক্ষ শিকারী ছিলেন , বৈচিত্র্যময় বন্য জীব-জন্তু শিকার করতেন ।
শিকার প্রসঙ্গে মালুশাও বলেছেন ,
ছোট বেলায় তার ছোট ভাইও শিকার করতেন । তিনি তাকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ের উপরে একবার গিয়েছিলেন । সেবার ছিল কনকনে শীত । শীতের ভয়ে তিনি পথেই কেঁদে উঠলেন । ফলে তিনি ও তার ছোট ভাই বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন ।
এখন বন্য প্রাণী সংরক্ষণ করার জন্য সরকার শিকার নিষিদ্ধ করেছে । আরোংপু ও তার স্ত্রী এই ব্যবস্থা খুব সমর্থন করেন । তবু আরোংপু তার আগের জীবনযাপন খুব পছন্দ করেন । তিনি প্রায়ই দুই ছেলেকে তার তখনকার শিকারের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অবহিত করেন । তার বড় ছেলের নাম ইলেই । তিনি প্রায়ই পাহাড়ে হরিণ পালন করেন । ছোট ছেলে ইসু পাহাড়ের নীচে থাকতে পছন্দ করেন । যখন সংবাদদাতা তার বাবার সঙ্গে গল্প করছিল , তখন ছোট ছেলে এক পাশে বসে একাগ্রচিত্তে ভিডিও ক্যাসেট উপভোগ করছিলেন ।
ইসুর বয়স ২৪ বছর । গোলগাল মুখে একটু লজ্জিত হাসি ফুটে উঠলো । কিন্তু যখন সংবাদদাতা ও তার বাবা তার আগ্রহী বিষয়ে গল্প করলেন , তখন তিনি খুব উত্ফুল্ল হয়ে উঠলেন । ই সু ফ্যাশনের জিনিস পছন্দ করেন । তার ইন্টারনেটের কাজ , ছায়াছবি ও আধুনিক গান খুব ভাল লাগে ।
বড়ে শহরে ই সুর চাকরি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে । দু' বছর আগে সে চাকরি করার জন্য প্রায়ই বাইরে যেতে । সে নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা করতো । সে যে বড় শহরের জীবনধারা পছন্দ করে , তার মূলে রয়েছে বড় শহরের জীবনধারা আধুনিক ও বৈচিত্র্যময় ।
সে বলেছে , শুধু বাড়িতে থাকলে কিছু আয় করা যাবে না । সুতরাং সে পেইচিং, থিয়ান চিন ,সেন ইয়াংসহ বড় বড় শহরে যেতে ইচ্ছুক । সে তালিয়ান শহরে থাকতে সবচেয়ে পছন্দ করে ।
এবছর আগস্ট মাস থেকে আরোংপু ও তার পরিবার পরিজন তাদের হরিণ পালন খামারে পর্যটন পরিসেবাও চালু করেছেন । ঔ রেন ছুন জাতির অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পর্যটন পরিসেবা বহু পর্যটকদের আকর্ষণ করেছে ।
কথাবার্তার সময় ই সু তার বাবা আরোংপুর প্রতি ব্যাপক শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রকাশ করেছে। গত বছর তাদের থানায় অনুষ্ঠিত এক উদযাপনী অনুষ্ঠানে ই সু ও তার বাবা ফ্যাশন শো কাপড় শো প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিল ।
পরিপল্পনা অনুযায়ী , আগামী বছর পর্যটন ব্যবসার মাধ্যমে তার পরিবারের আয় ১৫ হাজার ইউয়ানে দাঁড়াবে ।
এখন আরোংপু আত্মজীবনীভিত্তিক একটি বই রচনা করছেন । তিনি এই বই প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছেন । যাতে আরো বেশি লোক ঔ ওয়েন ক্ জাতির লোকদের জীবনধারণ ও এর পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানতে পারেন ।
এতক্ষণ ওরা অনন্য শোনার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ ।
|