দক্ষিণ পশ্চিম চীনের ছুনছিং শহর ও হুনান প্রদেশকে ভাগ করেছে সিছুয়ান নদী আছে । নদীর পাশে আছে লুং চিয়াছুন নামে এক গ্রাম। নদীর ওই পারের স্কুলে পড়তে যেতে চাইলে গ্রামের ছেলেমেয়েদেরকে সিছুয়ান নদী অতিক্রম করতে হয় । আগে নদীর উপর সেতু ছিল না । গ্রামের মিয়াওজাতির এক নারী শিক্ষক বিশ বছর ধরে ছেলেমেয়েদেরকে পিঠে করে স্কুলে পাঠানোর দায়িত্ব পালন করতেন ।
ছুংছিং শহরের আওতাধীন লুং চিয়াছুন ও হুনান প্রদেশের পামুছুন সি ছুয়ান নদীর দুপারের দুই গ্রাম । লুং চিয়াছুন গ্রামে ৫০-এরও বেশি পরিবারের মোট তিনশ'রও বেশি লোক বসবাস করেন । তারা সবাই মিয়াও কিংবা থুজাতির লোক । বসন্তকালে গ্রামের সর্বত্রই সর্ষে ফুল ফেটে ।
গ্রামের প্রাথমিক স্কুল কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা পড়তে পারত । দ্বিতীয় শ্রেণীর পড়াশুনা শেষ করার পর গ্রামের মিয়াও জাতি ও থুজাতির ছেলেমেয়েরা থানার অন্য স্কুলে যেতে বাধ্য হয় । কিন্তু স্কুলগুলো অনেক দূরে । পাহাড়ী পথ যেমন আঁকাবাঁকা তেমনি দুরূহ । মাঝেমধ্যে বিষাক্ত সাপও দেখা যায় । আগে ছেলেমেয়েরা দ্বিতীয় শ্রেণীর লেখাপড়া শেষ করার পর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিত । লুংচিয়া গ্রাম পাও আন থানার আওতাধীনে ।
থানার কেন্দ্রীয় প্রাথমিক স্কুলের প্রধান চৌ চিয়েনইউয়ুন বলেছেন, লুং চিয়াছুন থেকে পাওআন থানার যে কোনো এক স্কুলে যেতে ৭ কিলোমিটারের পাহাড়ী পথ অতিক্রম করতে হয় । পথটা অত্যন্ত দুরূহ এবং কষ্টকর ।
স্কুলে যাওয়ার উপযোগী ছেলেমেয়েরা সিছুয়ান নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে । কারণ নদীর ওপাড়ে একটি পামু প্রাথমিক স্কুল আছে এবং সেখানে যেতে মাত্র ১০ মিনিট লাগে ।কিন্তু স্কুলটা হুনান প্রদেশের অাওতাধীনে । স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে ১৯৮৭ সালে পামু প্রাথমিক স্কুল ছুংছিং শহরের অধীনস্থ লুংচিয়াছুন গ্রামের চল্লিশেরও বেশি ছেলেমেয়েকে গ্রহণ করতে রাজী হয় ।
হুনান প্রদেশে ছুংছিং শহরের ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার এক পূবশর্ত হিসেবে লুংচিয়াছুন গ্রামের মিয়াওজাতীয় শিক্ষিকা সি ইউয়ানইংকে পামু প্রাথমিক স্কুলে পড়াতে পাঠানো হয় । সে সময় নদীর উপরে কোনো সেতু ছিল না । তাই ছাত্রছাত্রীদেরকে নদী পার করানো তার কাজের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয় । তিনি বলেছেন ,ছাত্রছাত্রীদেরকে নদী পার করানো এক অত্যন্ত ঝামেলার কাজ । তাই আমার স্বামী বললেন, নদীর পানি কম হলে তুমি তাদেরকে পিঠে করে নিতে পার। আর নদীর পানি বেশি হলে আমি তোমাকে সাহায্য করব ।
এ দিন থেকে বাতাস হোক ,বৃষ্টি হোক শিক্ষিকা সি ইউয়ানইংয়ের পিঠ এই সব ছেলেমেয়ের একমাত্র নির্ভরযোগ্য সেতুতে পরিণত হয় । শিক্ষিকা সির পিঠে করে নদী পার হওয়ার দৃশ্য এখনো ছাত্রী ওয়াংম্যানের মনে আছে । সে বলেছে ,আমরা নদীর মাঝখানে এসে পিছন দিকে তাকিয়ে দেখলাম , নদীর তীব্র স্রোত এক বড় পাথরকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যে পাথর দিয়ে আমরা নদী পার হই । নদীর পাথরগুলো অত্যন্ত পিচ্ছিল , শিক্ষিকা সি অসাবধানে পানিতে পড়ে যান এবং জুতাও হারিয়ে ফেলেন ।
বহু বছর ধরে ছাত্রছাত্রীদের নদী অতিক্রম করানোর সময়ে তিনি কতবার পড়ে গেছেন তা তিনি নিজেও জানেন না । এক দলের পর আরেক দল ছাত্রছাত্রী এ নদী থেকে পাহাড়ের বাইরের বিশ্বে গেছে ।
১৯৮৯ সালের একদিন শিক্ষিকা সি শেষ ছেলেটিকে পিঠে নিয়ে যখন নদীর তীর থেকে কয়েক মিটার দূরে পৌঁছুলেন তখন বন্যা শুরু হল । ভাগ্য ভাল, শিক্ষিকা সি যথাসময় প্রচন্ড বন্যা এড়িয়ে যান । তাদের তীরে উঠবার সঙ্গেসঙ্গে ভয়াবহ বন্যা তাদের পাশ দিয়ে নিম্ন অববাহিকায় চলে যায় । সেই দৃশ্য মনে পড়লে শিক্ষিকা সির এখনো ভয় লাগে । তাই এ দিন থেকে তিনি যখন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নদীর পার হন তখন তিনি প্রথমে নদীর জল-স্রোতের খোজখবর নেন। আর যখন নদীর পানি বেড়ে যায় বা বন্যা হয় তখন তার স্বামী ওয়াং হুয়ানলিন তার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের নদী পার করেন ।
সি ইউয়ানইং ১৮ বছর ধরে ছাত্রছাত্রীদের পিঠে করে সিছুয়ান নদী পার করে আসছেন । শিক্ষিকা সির পিঠে পার করা প্রথম কিস্তির ছাত্রছাত্রীরা এখন বড় হয়েছেন। তাদের বাচ্চারা শিক্ষিকা সির পিঠে করে স্কুলে আসা-যাওয়া শুরু করেছে । সিছুয়ান নদীর স্রোত অব্যাহতভাবে সামনে বয়ে যাচ্ছে । নদীর উপর শিক্ষিকা সির পিঠ দিয়ে তৈরী সেতু এক দলের পর এক দল ছাত্রছাত্রীকে স্কুলে পাঠাছে ।
শিক্ষিকা সির বয়স এখন ৫০-এর কাছাকাছি । দুপুরবেলায় তিনি ছাত্রছাত্রীদের হোমওয়ার্ক শুদ্ধ করেন এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন । তার পর তিনি ছাত্রছাত্রীদেরকে নদী পর করান । দীর্ঘকাল ধরে পানিতে চলাচলের কারণে তার গুরুতর বাত হয়েছে । তিনি সবসময়ে ছাত্রছাত্রীদের কথা মনে রাখেন । অসুস্থ হলে তিনি বিছানায় ছাত্রছাত্রীদের পড়ান । তার সহকর্মী শিক্ষক ছেন ইচিয়েন মুগ্ধ হয়ে বলেছেন, অসুস্থ হলে তার খুব ব্যথা হয় এবং দাঁড়াতেও পারেন না । কিন্তু তিনি প্রায় বলেন, ছাত্রছাত্রীদের জন্য এবং কাজের জন্য আমি যা করেছি তার সবই মূল্যযোগ্য ।
সুস্থ্য হলে প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষিকা সি আবার কাজের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন । তিনি আগের মতো ছাত্রছাত্রীদের পিঠে নিয়ে নদী পার করান ।
শিক্ষিকা সির সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হল, বিগত ১৮ বছরে নদী পার হতে গিয়ে একজন ছেলেমেয়েও কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়নি । দীর্ঘকাল ধরে গ্রামের স্কুলে যাওয়ার উপযোগী ছেলেমেয়ের স্কুলে ভর্তি-হার ১০০শতাংশে বজায় রয়েছে । তিনি যে ছেলেমেয়েদের পিঠে করে নদী পার করিয়েছেন তাদের মধ্যে ৪জন দেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে এবং এদের মধ্যে কেউকেউ স্নাতক হয়ে বিদেশে পড়তে গেছে ।
২০০৫ সালে সিছুয়ান নদীর উপরে এক নতুন সেতু নির্মাণ করা হয় । লুং চিয়াছুন গ্রামের ছেলেমেয়েদের আরও নদীর পানির মধ্যে দিয়ে স্কুলে যেতে হয় না । কিন্তু আজ পযন্ত শিক্ষিকা সি ক্লাসের সিয়াও লুনপিন নামে এক বিকলাঙ্গ ছাত্রকে পিঠে করে স্কুলে আসা-যাওয়া করছেন । তিনি আশা করেন, সিয়াও লুনপিন আরও বেশি জ্ঞান লাভ করে এক যোগ্য মানুষ হবে । তিনি আশা করেন, নিজের ছাত্রছাত্রীরা ভবিষ্যতে দেশের জন্যে আরও বেশি সেতু নির্মাণ করবে, যাতে আগামী দিনের জীবনযাপন দিনদিন সুন্দর হয় ।
|