৩১ অক্টোবর চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এক খবরে জানা গেছে, চীনের উদ্যোগে চীন, উত্তর কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের নেতারা পেইচিংয়ে অনানুষ্ঠানিক এক বৈঠক আয়োজন করেছেন । তিন পক্ষ ছ'পক্ষীয় বৈঠকের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার বিষয় নিয়ে আন্তরিক ও গভীরভাবে মত বিনিময় করেছে । তাঁরা একমত হয়েছেন যে ,সম্প্রতি চীন, উত্তর কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াসহ ছ'পক্ষীয় বৈঠক আয়োজিত হবে । সংবাদমাধ্যমের মতে এবারের বৈঠকের সাফল্য হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর কারণে উত্তেজনাময় পরিস্থিতির প্রশমন করা ।
২০০৩ সালের আগস্ট মাসে ছ'পক্ষীয় বৈঠক শুরু হয়েছে । ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চতুর্থ দফার ছ'পক্ষীয় বৈঠক দু'পর্যায়ের ব্যাপক আলোচনার মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা প্রথমবারের মত এক যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে । বিবৃতিতে উত্তর কোরিয়া সকল পারমাণবিক অস্ত্র এবং পরিকল্পনা ত্যাগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব "পারমাণবিক অস্ত্রের অবিস্তার চুক্তিতে" আবার অংশ নিয়েছে । যুক্তরাষ্ট্র অবগত করেছে যে, কোরিয় উপদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পারমাণবিক অস্ত্র নেই এবং পারমাণবিক বা সাধারণ অস্ত্রের মাধ্যমেও উত্তর কোরিয়ার ওপর হামলা চালাতে চায় না । উত্তর কোরিয়া বলেছে, তার শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক জ্বালানী সম্পদ ব্যবহার করার সামর্থ্য আছে, বিভিন্ন পক্ষ তার প্রতি সম্মান প্রকাশ করেছে । চতুর্থ ছ'পক্ষীয় বৈঠক সাফল্য অর্জন করায় বিভিন্ন পক্ষ তাকে স্বাগত জানিয়েছে । কিন্তু ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত পঞ্চম ছ'পক্ষীয় বৈঠকের প্রথম অধিবেশনে বিভিন্ন পক্ষ যৌথ বিবৃতি দেয় নি । ছ'পক্ষীয় বৈঠক এ জন্য এখোনো বন্ধ রয়েছে । এ সম্বন্ধে উত্তর কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র পৃথক পৃথকভাবে নিজেদের মতামত প্রকাশ করেছে । উত্তর কোরিয়া মনে করে এর প্রধান কারণ হল চতুর্থ ছ'পক্ষীয় বৈঠক শেষ হওয়ার পর পরই যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক শাস্তির ব্যবস্থা নিয়েছে । যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, উত্তর কোরিয়া সন্দেহজনকভাবে নকল মার্কিন ডলার তৈরী করায় যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নিয়েছে । উত্তর কোরিয়া নকল মার্কিন ডলার তৈরী না করার কথা ঘোষণা করার পাশা পাশি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শাস্তি বাতিল করার দাবি জানিয়েছে । নইলে উত্তর কোরিয়া ছ'পক্ষীয় বৈঠকে পুনরায় অংশ নেবে না । যুক্তরাষ্ট্র জোর দিয়ে বলেছে, এ অর্থনৈতিক শাস্তি অবৈধ তত্পরতার জন্য আরোপ করা হয়েছে, তা ছ'পক্ষীয় বৈঠকের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই । ছ'পক্ষীয় বৈঠক বন্ধ থাকা অবস্থায় উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংলাপের দাবি জানিয়েছে , কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ছ'পক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমেই উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সংলাপ করবে । দু'পক্ষ দৃঢ়ভাবে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখায় ছ'পক্ষীয় বৈঠক এ পর্যন্ত আর শুরু হয় নি ।
এবারের চীন, উত্তর কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক চীনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হবে । এর আগে চীনের প্রেসিডেন্ট হু চিনথাও'র বিশেষ প্রতিনিধি থাং চিয়াস্যুয়ান পিয়োংইয়াং সফর করে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জোং ইলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ।
সম্প্রতি চীন , উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ছ'পক্ষীয় বৈঠকটি পুনরায় শুরু করার মতৈক্যে পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন পক্ষ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে । জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের মুখপাত্রের প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তিনি আশা করেন, ছ'পক্ষীয় বৈঠক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবার শুরু হবে এবং বৈঠকের পর ইতিবাচক সাফল্য অর্জন করবে । যাতে এ অঞ্চলের উত্তেজনাময় পরিস্থিতিকে প্রশমন করা যায় ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ৩১ অক্টোবর হোয়াইট হাউসে বলেছেন, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়া ছ'পক্ষীয় বৈঠকটি আবার শুরু করার চেষ্টাকে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন । তিনি উল্লেখ করেছেন যে, কোরিয় উপদ্বীপের পারমাণবিক সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে ব্যাপক কাজ চালানো হবে । তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন পক্ষের প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ গৃহীত উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের তাগিদ দেবে ।
দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র ও বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ছূ কুইহো বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়া সরকার আশা করে,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছ'পক্ষীয় বৈঠক আবার শুরু হবে এবং বৈঠকের মাধ্যমে "চতুর্থ ছ'পক্ষীয় বৈঠকের যৌথ বিবৃতি" চালু করার বিষয় নিয়ে একমত হবে,যাতে কোরিয় উপদ্বীপের পরমাণু অস্ত্রমুক্তকরণ বাস্তবায়ন করা যায় । তিনি আরো বলেছেন, ভবিষ্যতে দক্ষিণ কোরিয়া ছ'পক্ষীয় বৈঠকে অংশগ্রহণকারী দেশসমূহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরামর্শ করে কোরিয় উপদ্বীপের পারমাণবিক সমস্যার সমাধান এবং কোরিয় উপদ্বীপের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাবে ।
রাশিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী, ছ'পক্ষীয় বৈঠকের প্রতিনিধি দলের প্রধান আলেক্সান্ডার আলেক্সেয়েভ বলেছেন, রাশিয়া মনে করে, এবারের বৈঠক হচ্ছে একটি অতি বিরাট অগ্রগতি । রাশিয়া আশা করে , ছ'পক্ষীয় বৈঠক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবার শুরু হবে ।
জাপানের ক্যাবিনেট সচিবালয়ের মহা-পরিচালক শিওজাকি ইয়াসুহিসা বলেছেন, ছ'পক্ষীয় বৈঠক হচ্ছে কোরিয় উপদ্বীপের পারমাণবিক সমস্যা সমাধান করার সবচেয়ে ভালো কাঠামো । জাপান সরকার সম্প্রতি অনুষ্ঠিতব্য ছ'পক্ষীয় বৈঠককে স্বাগত জানিয়েছে । এর পাশা পাশি তিনি বলেছেন, উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্র বহনকারী দেশ হিসেবে ছ'পক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিলে, জাপান সরকার তা গ্রহণ করবে না । জাপান সরকার উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত শাস্তি বাতিল করবে না ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের নেতা ক্রিস্টোফার হিল চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত জানার পর চীনে মার্কিন দূতাবাসে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেছেন । তিনি বলেছেন, বিভিন্ন পক্ষের অনুমোদন পেলে, ছ'পক্ষীয় বৈঠক খুব সম্ভবত নভেম্বর বা ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে । তিনি আরো বলেছেন, উত্তর কোরিয়া ছ'পক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেয়ার ব্যাপারে শর্ত দাখিল করে নি ।
দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদমাধ্যম উল্লেখ করেছে যে, বর্তমানে উত্তর কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক শাস্তি বাতিল করা সম্পর্কিত কোন চুক্তি স্বাক্ষর হবে কিনা তা বলা যায় না । দক্ষিণ কোরিয়ার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তবে দু'পক্ষের মধ্যে অর্থনৈতিক শাস্তি বাতিল করার বিষয়ে কিছু অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে । তিনি আরো বলেছেন, ছ'পক্ষীয় বৈঠক এবং উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সমস্যা সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবটি পৃথক পৃথকভাবে বাস্তবায়ন করা হবে । ছ'পক্ষীয় বৈঠকের ভবিষ্যতের ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষজ্ঞরা পূঙ্খানুপুর্ণভাবে বিশ্লেষণ করছেন । তাঁরা মনে করেন, উত্তর কোরিয়া নিজেই পারমাণবিক অস্ত্রের বহনকারী দেশ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয় । তা বৈঠককে আরো জটিল তায় ফেলে এবং আরো বিরাট বাধার সম্মুখীন হতে পারে ।
|