এতক্ষণ আপনারা যা শুনেছেন , তা উ সু লি নদীর জেলে নামে একটি লোক সংগীত । সংগীতটি হে চে জাতির লোক সংগীতের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে । চীনের ৫৫টি সংখ্যালঘু জাতির মধ্যে হে চে জাতি অন্যতম সবচেয়ে অল্প লোকসংখ্যার জাতি । এখন তাদের লোকসংখ্যা ৫ হাজারেরও কম । তারা উত্তর-পূর্ব চীনের তিনটি নদী- হেইলুং নদী , উসুলি নদী ও সুংহুয়া নদীর অববাহিকায় বাস করেন এবং বংশপরম্পরায় মাছ ধরা ও পশু শিকারের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করেন ।
ভোর বেলায় উসুলি নদী মেঘাচ্ছন্ন । নদীর পানি স্বচ্ছ । হেইলুংচিয়াং প্রদেশের লাওহো জেলার শিফেই থানার হে চে জাতির জেলে ইউ মিন চি ও তার ছেলে মাছ ধরতে নৌকা চালিয়ে বাইরে গেলেন । নৌকা ২০ মিনিট চালানোর পর তারা মাছ ধরার এলাকায় পৌঁছুলেন ।
সংবাদদাতা তাদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করলেন । তারা সংবাদদাতাকে বলেন , নদীতে মাছ ধরার সুবিধার জন্য জেলেদের মাছ ধরা নৌকাসমূহ এক সঙ্গে বাঁধা । কিন্তু মাছ ধরার জন্য সকল নৌকা থেকে সঙ্গে সঙ্গে জাল ছুড়ে ফেলা হয় না । বরং একটির পর একটি নৌকা থেকে নিক্ষেপ করা হয় । নইলে দুর্ঘটনা হতে পারে । পানিতে গাছের ডালে আটকালে জাল ছিড়ে যাবে ।
সূর্যোদয় হল । কুয়াশা ধীরে ধীরে চলে গেল । নদীর গাঢ় সবুজ রঙের পানি সোনালী রঙ হয়ে দাঁড়াল । প্রথম মাছ ধরার নৌকা থেকে জাল ছুড়ে ফেলা হল । শাদা রঙের জাল মাছের শরীরের মতো ঝকঝকে । উসুলি নদীতে হে চে জাতির জেলেদের মাছ ধরতে জাল নিক্ষেপ থেকে জাল ফিরিয়ে আনার জন্য সাধারণতঃ ৪০ মিনিট লাগে । ইউ মিন চির সামনে আরো দু'খানি মাছ ধরা নৌকা অপেক্ষা করছিল । সুতরাং তার মাছ ধরার জন্য আরো এক ঘন্টারেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে । মাছ ধরার জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকে ফাঁকে জেলেরা যার যার মাছ ধরার অভিজ্ঞতা বিনিময় করলেন ।
হে চে জাতির বেশির ভাগ জেলে নদীতে দশ-বারো বছর এমন কি কয়েক দশক মাছ ধরেছেন । নদীতে কি কি মাছ আছে এবং কি পদ্ধতিতে মাছ ধরা হয় , এ সব বিষয়ে তারা খুব পারর্দশী । তাদের মধ্যে কনিষ্ঠতম ইউ চ্যুন থাও মাছ ধরার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন । ইউ চ্যুন থাও ইউ মিন চির ছেলে । হে চে জাতির বেশির ভাগ লোকের সঙ্গে তিনি ভিন্ন যে , তিনি বড় শহরে কয়েক বছর ছিলেন । তার লম্বা চুল হলুদ রং করা হয়েছে , ধূমপানের চালচলনও আধুনিক ।
তার বয়স ২৩ বছর । তিনি মাছ ধরার মাধ্যমে রোজগার করেন । শীতকালে তিনি হস্তশিল্প দ্রব্য বানান । গাছের চামড়ার ওপরে চিত্রাঙ্কন করেন । এই হস্তশিল্প দ্রব্য বানানোর নৈপুণ্য কয়েক প্রজন্ম ধরে প্রচলিত করেছে । তার দাদা ,বাবা , চাচা ও মামা সবাই এই হস্তশিল্প দ্রব্য তৈরীতে নিয়োজিত আছেন । এটা হে চে জাতির এক ধরনের ঐতিহ্যিক হস্তশিল্প দ্রব্য । ইউ চ্যুন থাও জাতির এই ঐতিহ্য উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করেছেন ।
তিনি সংবাদদাতাকে বলেছেন , আগে হে চে জাতির লোকেরা ছোট কাঠের নৌকা চালিয়ে মাছ ধরতেন । এখন বাড়িতে বাড়িতে ইঞ্জিন চালিত মাছ ধরা নৌকা ব্যবহৃত হচ্ছে । তিনি যথাশীঘ্র তা চালানো শিখেছেন করতে পেরেছেন । বাবা তার জন্য খুব গৌরব বোধ করেন ।
এখন ইউ চ্যুন থাও'র বাবার জাল ছুড়ে দেয়ার পাল্লা । মাছ ধরা নৌকা দূরে চলে গেল । বাবা ও ছেলের ছায়া ধীরে ধীরে অদৃশ্য হল । তবে দূর থেকে উত্সাহব্যঞ্জক ও মর্মস্পর্শী লোক সংগীত শোনা যাচ্ছে ।
দুপুর বেলায় টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে । অন্ধকার এল । ইউ চ্যুন থাও ও তার বাবার এক দিনের পরিশ্রম শেষ হল । তাদের ভাগ্য ভাল । মাছের ঝুড়িতে বৈচিত্র্যময় মাছ রয়েছে । নদীর ধারে মাছ কিনতে ফেলিওয়ালারা ছুটে এলেন । কিছু ক্ষণের পর ইউ চ্যুন থাও'র সব মাছ বিক্রি হয়ে গেছে । তার ১ শো ইউয়ানেরও বেশি আয় হয়েছে ।
দুপুর বেলায় সংবাদদাতা হে চে জাতির সুং সাহেবের বাসায় খেয়েছেন । তার বাসা হে চে জাতির খাঁটি বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ । তার বাড়ি মাটি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে । রান্নার জন্য উনুনও মাটি দিয়ে বানান হয়েছে । ঘরে মাছের চামড়া দিয়ে প্রস্তুত হস্তশিল্প দ্রব্যও যেখানে সেখানে দেখা গেল । সুং সাহেব হে চে জাতির এমন একজন দুর্লভ অধিবাসী , যিনি হে চে জাতির ভাষা বলতে পারেন । হে চে জাতির নিজের লিখিত ভাষা নেই । কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে মাছ ধরা ও পশু শিকার জীবনে তারা নিজের জাতির মৌখিক ভাষা উদ্ভাবন করেছেন । এখন হে চে জাতির লোকদের মধ্যে যারা হে চে জাতির ভাষা বলতে পারেন , তাদের সংখ্যা খুব কম ।
সুং সাহেবের বয়স ৫৪ বছর । তিনি প্রায়ই হে চে জাতির ভাষায় কথা বলেন । তার বাবা মাও হে চে জাতির ভাষা বলতে পারেন । তবু দুঃখের বিষয় এই যে , লিখিত ভাষা ছাড়া ভাষা উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করা খুব কঠিন ।
দুপুরের খাওয়া শেষে হলে ঝমঝম বৃষ্টি শুরু হল । নদীর উপরে আবার কুয়াশাচ্ছন্ন । কুয়াশার মধ্য দিয়ে ওপারের লাইট স্টেশন ও সেনা ফাঁড়িও ম্লানভাবে দেখা গেল । কারণ নদীর ওপার তো রাশিয়ার ভূভাগ ।
সংবাদদাতা হে চে জাতির জেলে কাও ওয়েনের মাছ ধরা নৌকায় উঠলেন । নৌকা নদীর মাঝখানের দিকে এগুচ্ছে । সংবাদদাতা ছটফট করলেন । কারণ নদীর মাঝখান দু'দেশের সীমান্তরেখা । অসাবধানে সীমান্ত পার হলে মুষ্কিল হতে পারে । এই বিষয় কাও ওয়েনও স্পষ্ট জানেন ।যখন সংবাদদাতা নদীর ধারে ফিরে এলেন , তখন নদীতে ইউ চ্যুন থাও ও তার বাবা সংবাদদাতাকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানালেন । এখন আবার তার পরিবারের মাছ ধরার পালা । দিনে চার বার মাছ ধরা জাল ছুড়ার কথা । তাদের এক দিনের কাজ মধ্য রাত পর্যন্ত চলবে । নদীর ধারে হে চে জাতির বাড়িতে বাড়িতে রান্না শুরু হল । নদীতে মাছ ধরার নৌকা থেকে জেলেদের গান অবিরামভাবে শোনা যাচ্ছে ।
|