চীনে নু জাতি অল্প লোকসংখ্যার জাতিগুলোর মধ্যে অন্যতম । তারা প্রধানতঃ দক্ষিণ পশ্চিম চীনের ইউন নান প্রদেশের নু নদীর অববাহিকায় ছড়িয়ে পড়েন । পর্বতমালায় আবৃত এই এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত পশ্চাত্পদ ছিল । সুতরাং দীর্ঘকাল ধরে নু জাতির আর্থ-সামিজিক উন্নয়ন অপেক্ষাকৃত অনুন্নত ছিল । এখন স্থানীয় সরকারের সাহায্যে নু জাতির বেশ কিছু পরিবারে ঘরোয়া হোটেল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । পর্যটন শিল্প চালানোর উপর নির্ভর করে কৃষকরা স্বচ্ছল হয়ে উঠেছেন । আজ এই অনুষ্ঠানে নু জাতির একটি পল্লীগ্রাম-চিয়া সেন গ্রাম সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলছি আমি… এতে পর্যটন শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে নু জাতির জীবনযাপনের পরিবর্তন প্রকাশ পাবে ।
ইউন নান প্রদেশের রাজধানী খুনমিন থেকে ১১ ঘন্টা গাড়িতে করে নু জাতি অধ্যুষিত কুং সান নু জাতি তু লুং জাতি স্বায়ত্তশাসিত জেলায় পৌঁছুলেন । তার পর আরো এক ঘন্টারও বেশি সময় গাড়িতে করে চিয়া সেন গ্রামে পৌঁছুলেন । দূর থেকে তাকালে গ্রামটি পর্বতমালায় ঘেরা । চার দিকে একটি নিবিড় অরণ্য বিস্তৃত । গাড়ি চিয়া সেন গ্রামে প্রবেশ করল । সংবাদদাতা দেখলেন , পল্লী সড়কের দু'পাশে কাঠ দিয়ে নির্মিত নু জতির একটির পর একটি বাড়িঘর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে । বাড়িঘর থেকে নু জাতির লোক সংগীত শোনা যাচ্ছে ।
সংবাদদাতা গ্রামবাসী লিউ ইয়াং হাই-এর বাড়িতে প্রবেশ করলেন । তিনি বাসায় অতিথিদের দাওয়াত করছেন । সংবাদদাতা দেখলেন , পাহাড়ী গ্রামের একটি কৃষক পরিবারে রঙ্গিন টিভি , রিফ্রিজ্যারেটর , কাপড় ধোয়া যন্ত্র ,অডিও-ভিডিও ইত্যাদি গার্হস্থ্য ব্যবহার্য ইলেকট্রোনিক্স দ্রব্য সাজানো হচ্ছে । কিন্তু আগে নু জাতির কৃষকরা অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন । লিউ ইয়াং হাই সংবাদদাতাকে বলেন , আগে তার পরিবারও খুব গরীব ছিল । বাড়িতে ঘরোয়া হোটেল চালু হওয়ার পর তারা দিন দিন সমৃদ্ধ হয়ে উঠছেন ।
গ্রামে পর্যটন কার্যকম চালু হওয়ার আগে তার পরিবারের আয় কম ছিল । পরিবারের জীবনযাপন শুধু চাষাবাদ , হাঁস-মুর্গী পালনের ওপর নির্ভরশীল ছিল ।
ছ' বছর আগে দারিদ্র্য দূরীকরণ করতে নু জাতির লোকদের সাহায্য করার জন্য স্থানীয় সরকার নু নদীর অববাহিকার বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে গ্রামবাসীদের পর্যটন কার্যক্রম বিকশিত করতে সহায়তা করেছে । স্থানীয় সরকারের উত্সাহে লিউ ইয়াং হাই আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে কিছু টাকা-পয়সা ধার করলেন । তিনি কয়েকটি ঘর নির্মাণ করে ঘরোয়া হোটেল গড়ে তুললেন । ঘরোয়া হোটেল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে জেলা শহর ও প্রদেশের রাজধানী থেকে আসা পর্যটকের সংখ্যা অধিক থেকে অধিকতর হয়েছে । তারা নু জাতির ঘরোয়া হোটেলে সংখ্যালঘু জাতির খাবার খান এবং নু জাতির নাচ গান উপভোগ করেন ।
লিউ ইয়াং হাই বলেছেন , তার স্ত্রীর রান্না করা খাবার অতিথিদের ব্যাপক কদর পেয়েছে । তার রান্না করা খাবার সত্যি খুব সুস্বাদু ।
লিউ ইয়াং হাই বলেন , ঘরোয়া হোটেল চালু হওয়ার পরবর্তী ছ' বছর ধরে তার বাড়িতে বছরে কমপক্ষে ২০ হাজার ইউয়ান আয় বেড়েছে । তিনি যেমন ঋণ পরিশোধ করেছেন , তেমনি বাড়িতে বেশ কিছু ইলেকট্রোনিক্স দ্রব্যও কিনেছেন । তা ছাড়া ব্যাংকে তার কিছু আমানতও রয়েছে । কথা বলতে বলতে ঘরে ফোনের ঘন্টা বেজে উঠলো ।
লিউ ইয়াং হাই মৃদু হেসে সংবাদদাতাকে বলেন , জেলা শহরের এই ফোনে তার ঘরোয়া হোটেল থেকে খাবার কেনার অর্ডার দেয়া হয়েছে । ঐদিন রাতে জেলা শহর থেকে পর্যটকরা তার ঘরোয়া হোটেলে আসার কথা । লিউ ইয়াং হাই ও তার পরিবারের লোকেরা কাজে ব্যস্ত ছিলেন । সংবাদদাতা অন্য গ্রামবাসীদের বাড়িতে চলে গেলেন ।
লিউ ইয়াং হাই-এর প্রতিবেশীর বাড়িতে নু জাতির জাতীয় পোষাক পরা একজন মেয়ে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল । তার পোষাক ঘরোয়া বোনা বস্ত্র দিয়ে তৈরী করা হয়েছে । বস্ত্রের উপরে ছোট ছোট রঙবেরঙের ফুল রং করা হয়েছে । তার বাড়ির প্রাঙ্গন লিউ হাই ইয়াংয়ের বাড়ির প্রাঙ্গনের চেয়ে আরো বড় । প্রাঙ্গনে একটি ছোট পুকুর ও কয়েকটি কৃত্রিম পাহাড় নির্মাণ করা হয়েছে । পুকুরের ধারে একটি প্যাভিলিয়নও আছে । এই মেয়ের বাড়িতেও ঘরোয়া হোটেলের ব্যবসা করা হচ্ছে ।
মেয়েটির নাম খাই ছু । তার বয়স ২৩ । তার বাড়িতেও ২০০০ সালের গোড়ার দিক থেকে ঘরোয়া হোটেলের ব্যবসা চালু করা হয় । এর আগে তার বাবা জেলা শহরে চাকরি করতেন । তার মা গ্রামে একটি মুদির দোকানের ব্যবসা করতেন । খাই ছুও বাইরে চাকরি করতেন । তার পরিবার গ্রামের অন্যান্য পরিবারের চেয়ে সামন্য একটু স্বচ্ছল ছিল । ঘরোয়া হোটেলের ব্যবসা চালু হওয়ার পর তার পরিবার দিন দিন সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে । হোটেলের ব্যবসা দেখাশুনা করার জন্য খাই ছুও গ্রামে ফিরে এলেন । বাইরে চাকরি করায় তার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে । তিনি সংবাদদাতাকে বলেন , ঘরোয়া হোটেল চালু হওয়ায় যেমন পরিবারের জন্য আয় বেড়েছে , তেমনি এতে নু জাতির সংস্কৃতি প্রচার ও সম্প্রসারণের ভূমিকাও পালন করা হয়েছে । কারণ হোটেলে পর্যটকদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি নু জাতির বহু রীতি-নীতিও সংরক্ষিত হয়েছে ।
গল্প করতে করতে খাই ছু সংবাদদাতাকে নু জাতির মদ খাওয়ানো সংক্রান্ত একটি গান গাইলেন । তিনি তার পরিবারের বানানো চালের মদ খেতে দিলেন । তিনি বলেছেন , অতিথিদের নু জাতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন খাবারের বন্দোবস্ত করা ছাড়া তিনি ও গ্রামের অন্যান্য মেয়েরা অতিথিদের জন্য নু জাতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন । তিনি বলেন , নু জাতির অনন্য সংস্কৃতি আরো বেশি পর্যটককে আকর্ষণ করছে । পরবর্তী পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন ,
পর্যটকদের সংখ্যা আরো বেশি বেড়ে গেলে তিনি একটি শিল্পী দল গঠনের কথা বিবেচনা করবেন । প্রথমতঃ গ্রামের ঘরোয়া হোটেলগুলোতে এই শিল্পী দলের নাচ গান পরিবেশন করা যাবে । দ্বিতীয়তঃ নু জাতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নতুন বাড়িঘর নির্মাণ করা হবে এবং তৃতীয়তঃ গ্রামবাসীরা পর্যটকদের জন্য হোটেল ও শাক-সবজি বন্দোবস্ত করবেন । অতিথিরা নিজেরা রান্না-বান্না করতে পারবেন এবং এতে তারা নু জাতির নিখুঁত জীবনধারণ অনুভব করতে পারবেন ।
|