২০০৬ সালের মার্চ মাসে চীনের চিয়াংসি প্রদেশের কানচৌ শহরের গণ হাসপাতালে একশরেরও বেশি ছেলেমেয়ে পরীক্ষার জন্যে অপেক্ষা করছিল । কানচৌ শহরের প্রত্যন্ত গ্রামের এই সব ছেলেমেয়ের জন্মগত হেয়ারলিপ ও চিড় তালু হয়েছে । দারিদ্র্য অথবা নানা কারণে তারা চিকিত্সা পায়নি । এই সব ছেলেমেয়ের মধ্যে বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের বয়স ৩-৪ বছর । তাদের মধ্যে লো চিনইং নামে এক মেয়ে, তার বয়স ১২ বছর ।
দুর্ভাগ্য যে ,লো চিনইংয়ের জন্মগত হেয়ারলিপ ও চিড় তালু হয়েছে । ডাক্তার বলেন ,শল্যচিকিত্সার মাধ্যমে তা ভাল করা যায় । ৩-৪ বছর বয়সে এ ধরণের শল্যচিকিত্সা করা ভাল । কিন্তু চিনইংয়ের মার গর্ভকোষের টিউমার চিকিত্সার জন্যে বাবার সব টাকাপয়সা শেষ হয়েছে বলে চিনইংয়ের চিকিত্সার জন্যে বাবার আর সামর্থ্য নেই । এখন চিনইং নিম্নমাধ্যমিক স্কুলে লেখাপড়া করছে । লেখাপড়ায় ভাল পয়েন্ট পেলেও হেয়ারলিপ হওয়ার কারণে চিনইং মানসিক চাপে ভোগে । ক্লাসের সময় সে কখনো সক্রিয়ভাবে হাত তুলে শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর দেয় না । সে কখনো উদ্যোগ নিয়ে সহপাঠীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে না । চিনইংয়ের মুখে তার সমবয়সী মেয়ের প্রফূল্লতা ও হাসি দেখা যায় না ।
হেয়ারলিপ ও চিড় তালু এক ধরণের জন্মগত রোগ । দক্ষিণ চীনের গ্রামাঞ্চলে এধরণের রোগ বেশি হয় । এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় , ২০০৫ সালে এ রোগের হার ছিল ১.৮শতাংশ । শুধু চীনের চিয়াংসি প্রদেশে প্রত্যেক বছরে ১ হাজার ৮০০ জন হেয়ারলিপ বা চিড় তালু শিশুর জন্ম হয় । এধরণের জন্মগত ত্রুটির জন্যে উত্তম উপায় হল চিকিত্সার উত্তম সময়ে অপারেশনের মাধ্যমে তা সারানো । কারণ চিড় তালু শিশুর চোষার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে । যার ফলে শিশুর শ্বাস-নিঃশ্বাস বন্ধ হবার সম্ভাবনা থাকে । হেয়ারলিপ ও চিড় তালু শিশুর মৃত্যুর হার অপেক্ষাকৃত বেশি ।
প্রত্যন্ত দরিদ্র এলাকায় প্রাকৃতিক অবস্থার কারণে বহু অভিভাবকরা জানেন না যে,শল্যচিকিত্সার মাধ্যমে নিজের সন্তানের হেয়ারলিপ সারানো যায় । চীনের জাতীয় লোকসংখ্যা ও পরিবার পরিকল্পনা কমিশনের সমর্থন ও পরিচালনায় চীনের লোকসংখ্যা কল্যাণ তহবিল সংস্থা এক প্রকল্পের আয়োজন করে । এই প্রকল্পে চীনের চিকিত্সক ও বিদেশী চিকিত্সা বিশেষজ্ঞদের যৌথ চিকিত্সা দল চিয়াংসি প্রদেশের কানচৌ শহরে এসে বিনাখরচে হেয়ারলিপ ও চিড় তালু বাচ্চাদের চিকিত্সা করেন ।
শল্যচিকিত্সার আগে পরীক্ষার জন্যে এই দিন একশরও বেশি ছেলেমেয়ে হাসপাতালে জমা হল । লো চিনইং তাদের মধ্যে একজন । ইনফেকশন ,কাশি বা জ্বর প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দিলে শল্যচিকিত্সা করা যায় না । কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করে চিনইং ও তার মা অস্থির । কারণ শল্যচিকিত্সা তাদের আশা পূরণ করার প্রথম পদক্ষেপ । ডাক্তারের হাতে পরীক্ষা পাশকারীদের নামের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভূক্ত থাকবে চিনইং মনেপ্রাণে এই প্রার্থনা করে । ভাগ্য ভালো , চিনইংয়ের পরীক্ষার ফলাফল শল্যচিকিত্সার শর্তের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায় ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন , হেয়ারলিপের চিকিত্সার উত্তম সময় হল জন্মের তিন মাসের মধ্যে আর চিড় তালুর চিকিত্সার উত্তম সময় হল জন্মের ১২ মাসের মধ্যে । সাধারণত এই চিকিত্সা ১২ বছর বয়সের মধ্যেই করা হয় । ডাক্তারের কথায় চিনইং ও মা হতাশ হন । কারণ ১২ বছর বয়সী চিনইংয়ের চিকিত্সার উত্তম বয়স পার হয়ে গেছে । অপারেশন করা হলেও ফল ভাল হবে না । কিন্তু মা এই কথা বিশ্বাস করেন না । তিনি চিনইংকে নিয়ে আবার আন্তর্জাতিক চিকিত্সা দলের সামনে হাজির হন । অবশেষে চিনইংয়ের আশাপূর্ণ দৃষ্টিতে ডাক্তাররা মুগ্ধ হন । ডাক্তারের প্রস্তাবে চিনইংয়ের হেয়ারলিপ ও চিড় তালুর চিকিত্সা পৃথকভাবে দু'বারে করা হবে ।
হেয়ারলিপ শল্যচিকিত্সা শুরু হয়েছে । ডাক্তার চিনইংকে অপারেশন রুমে নেন । অবশ করার আগে ডাক্তার চিনইংকে অবশের তাত্পর্যব্যাখ্যা করেন । তার ভয় দূর করার জন্যে ডাক্তার তাকে উত্সাহ দিয়ে বলেন, আজ থেকে তুমিই সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে । ডাক্তার তাকে অবশ করার পর চিনইং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে । আসলে চিড় তালুর শল্যচিকিত্সা জটিল নয় । কিন্তু অবশ করা এই অপারেশনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ । চিনইং দু-এক মিনিটের মধ্যে অপারেশন করা যেতে পারে এমন অবশ অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে । দেশি-বিদেশী ডাক্তারদের মিলিত প্রচেষ্টায় চিনইংয়ের শল্যচিকিত্সা সাফল্যের সঙ্গে শেষ হয়েছে । ডাক্তাররা বলেছেন, শল্যচিকিত্সা বাচ্চাদের চেহারা পরিবর্তন করতে পারে । কিন্তু ভাষা ও মানসিকতার দিক থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া শল্যচিকিত্সার পর এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ । দীর্ঘ সময় ধরে প্রশিক্ষণ নিতে অটল থাকতে হবে ।
তিন মাস পর যখন আবার চিনইংয়ের সঙ্গে দেখা হয় তখন উপলব্ধি করতে পারে যে , চিনইংয়ের পাশে এখন অনেক বন্ধু আছে । চিনইং আগের মতো এখন কাউকে এড়িয়ে যায় না ,সে এখন নিঃসঙ্গ নয় । সে এখন আগের মতো মুখ ঢেকে কথা বলে না । সে এখন অন্যদের সঙ্গে আদানপ্রদান করতে ভয় পায় না । অন্য ছেলেমেয়ের মতো সে এখন হাসিমুখে কথা বলে । চিনইংকে চেনা সবাই বলেন, অস্ত্রচিকিত্সা গ্রহণের পর চিনইংয়ের যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে তা হল আত্মবিশ্বাস । এখন অন্য মেয়েদের মতোই আনন্দ আর হাসি চিনইংয়ের মুখে ফিরে এসেছে । এটাই লো চিনইংয়ের কাহিনী । মনে রাখুন , হেয়ারলিপ ও চিড় তালু ভয়ের ব্যাপার নয় । এর চিকিত্সা করা যায় । যদি আপনি এমন শিশুর খোঁজখবর পান তাহলে তার বাবামাকে সান্ত্বনা দেন এবং তাদেরকে জানান, শল্যচিকিত্সার মাধ্যমে হেয়ারলিপ সারানো যায় । চিকিত্সার উত্তম সময় হল শিশুর জন্ম হওয়ার ৩-চার মাস আর চিড়তালু সারানোর উত্তম সময় হল জন্মের ১২ মাসের মধ্যে ।
|