মধ্য চীনের হোনান প্রদেশ হচ্ছে চীনের প্রাচীন সভ্যতার উত্স স্থলের অন্যতম। সুদীর্ঘ ইতিহাসে হোনান প্রদেশে বিপুল পরিমাণ ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে হোনানে আবিষ্কৃত পুরাকীর্তির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। হোনান জাদুঘর হচ্ছে চীনের তিনটি বৃহত্তম জাদুঘরের একটি।
হোনান জাদুঘর হোনান প্রদেশের রাজধানী চাংচৌতে। এর ইতিহাস ৭০ বছরের বেশি। প্রধান ভবনের নকশা বর্তমানে চীনে সংরক্ষিত সবচাইতে আগের জ্যোতির্বিদ্যা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ধ্বংসাবশেষের অনুকরণে নির্মিত । ভবনটি দেখতে খুবই জাঁকজমকপূর্ণ। এই জাদুঘরে ১৩ লাখ সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ রয়েছে । এই সংখ্যা চীনের জাতীয় পর্যায়ের সকল জাদুঘরের সংরক্ষিত সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের মোট সংখ্যার আট ভাগের এক ভাগ। বলা হয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকে মূল্যায়ন করলে চীনের সকল জাদুঘরের মধ্যে পেইচিংয়ের রাজপ্রাসাদ জাদুঘর প্রথম স্থান অধিকার করে আছে, হোনান জাদুঘর রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে । হোনান জাদুঘরের মহাপরিচালক দিং ফু লি জানিয়েছেন, "হোনান জাদুঘরের প্রদর্শনীর মধ্যে কিছু কিছু জিনিস অদ্বিতীয়। যা চীনের অন্য জাদুঘরে সহজে দেখা যায় না। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে হোনান প্রদেশ ভ্রমণকারী পর্যটকদের হোনান জাদুঘরে পরিদর্শন না করা সত্যিকারভাবেই পরিতাপের ব্যাপার।"
দিং ফু লি বলেছেন, হোনান জাদুঘরে সংরক্ষিত পুরাকীর্তির মধ্যে ব্রোন্জ নির্মিত পাত্র সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। ব্রোন্জ নির্মিত পাত্র প্রধানতঃ ব্রোন্জ আর অল্প পরিমাণের টিন ধাতু ও সীসা মিশিয়ে নির্মিত । এর রং নীলাভ ধূসর । চার হাজার বছর আগে চীন ব্রোন্জ নির্মিত পাত্র নির্মাণের প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে। চীনের ব্রোন্জ নির্মিত পাত্রের চমত্কার নিমার্ণ এবং এর উচ্চ মানের প্রযুক্তির কারণে সারা বিশ্বে তা সমাদৃত। প্রাচীনকালে ব্রোন্জ নির্মিত পাত্র চীনে ক্ষমতা ও মর্যাদার প্রতীক ছিলো। তাকে ভোজসভায় খাদ্য রাখার মূল্যবান পাত্র বা মন্দিরে পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় ব্যবহার করা হতো। ব্রোন্জ নির্মিত পাত্রের গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি মূল্য রয়েছে বলে কেউ কেউ বলেন, পৃথিবীতে চীনের ব্রোন্জ নির্মিত পাত্রের প্রভাব প্রাচীন মহাপ্রাচীরের চেয়ে কম নয়।
হোনান চীনের ব্রোন্জ যুগের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র ছিলো। সে জন্য সেখানে বিপুল পরিমাণ ব্রোন্জ নির্মিত পাত্র খনন শেষে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু অতি মূল্যবান পাত্র হোনান জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এই ব্রোন্জ নির্মিত পাত্রগুলোর উপাদানের গুণগতমান, বৈশিষ্ট্যসূচক আকার ও ভাস্কর্য এবং সুন্দর চিত্রের মাধ্যমে প্রাচীন চীনের ব্রোন্জ সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন হোনান জাদুঘরের "রাজকুমারের আদেশ নামক ক্রমিক ঘন্টা" হচ্ছে এক অদ্ভূত বস্তু।
ক্রমিক ঘন্টা হচ্ছে এক ধরনের বড় আকারের পার্কাশান বাদ্যযন্ত্র এবং মন্দিরে উত্সর্গ ও রাজপ্রাসাদে ভোজসভায় ব্যবহৃত উত্সর্গিত পাত্র। "রাজকুমারের আদেশ নামক ক্রমিক ঘন্টার" নির্মাতা প্রাচীনকালের একজন রাজার বংশধর ছিলেন। তিনি নিজের বাবার স্মরণে এই ঘন্টা নির্মাণ করলেন। ঘন্টার উপর খোদাই করা রচনায় সেই ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে। হোনান জাদুঘরের টীকাকার ম্যাডাম লিউ হাং জানিয়েছেন, এই ক্রমিক ঘন্টার ইতিহাস প্রায় ২৫০০ বছরের। তিনি বলেছেন, "২৬টি ঘন্টা নিয়ে গঠিত এই 'রাজকুমারের আদেশ নামক ক্রমিক ঘন্টার' মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘন্টাটির ওজন ১৫২.৮ কিলোগ্রাম। সবচেয়ে হালকা ছোট ঘন্টাটির ওজন ২.৮ কিলোগ্রাম। এই ঘন্টার সেটটি দিয়ে আমরা আধুনিক যুগের বিভিন্ন সুর বাজাতে পারি। এটা হচ্ছে চীনে আবিষ্কৃত ২৫০০ বছর আগেকার বসন্ত ও শরত্ যুগে নির্মিত সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত ঘন্টা। "
হোনান জাদুঘরের আরেকটি অমূল্য পাত্র হচ্ছে "পদ্ম ও সারস হাঁড়ি"। এ হাঁড়ির আকার সাধারণ ব্রোন্জ নির্মিত পাত্রের চেয়ে অনেক ছোট। এই হাঁড়ির উচ্চতা মাত্র ১২ সেন্টিমিটার, তাকে প্রাচ্যের সুন্দরত্তম ব্রোন্জ নির্মিত পাত্র বলা হয়। ১৯২৩ সালে হোনানের সিনচাং নামক একটি জায়গার একজন কৃষক নিজের বাগানে কূপ খনন করার সময় "পদ্ম ও সারস হাঁড়ি"আবিষ্কার করেছেন। এ পাত্রের ইতিহাসও কমপক্ষে ২৫০০ বছরের বেশি। হাঁড়ির উপরে প্রস্ফুটিত পদ্ম ফুল , পদ্ম ফুলের মাঝখানে একটি সারস দাঁড়িয়ে আছে। জানা গেছে, "পদ্ম ও সারস হাঁড়ি" দাস সমাজের শেষ দিকে নির্মিত হয়। তাকে ব্রোন্জ যুগের চূড়ান্ত শীর্ষ কাজ বলে অভিহিত করা হয়।
তা ছাড়া, হোনান জাদুঘরের আরেকটি বিখ্যাত পুরাকীর্তি হচ্ছে "ব্রোন্জ ও লৌহ দিয়ে তৈরি তরবারি"। এটা হচ্ছে আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত চীনের সবচাইতে পুরানো মনুষ্যনির্মিত লৌহ বস্তু, তাই তাকে "চীনের প্রথম তরবারি" বলা হয়। হোনান জাদুঘরের কর্মচারী লিউ হাং জানিয়েছেন, "এই লৌহ তরবারির আবিষ্কার গোটা প্রত্নতত্ববিদদেরবিস্মিত করেছে। এই তরবারির হাতল মণি দিয়ে তৈরি, মণির ভিতর ব্রোন্জ রয়েছে। তরবারির প্রধান অংশ লোহা। ২৮০০ বছর আগে কিভাবে ব্রোন্জ, মণি ও লোহা প্রভৃতি জিনিস একসাথে মিশিয়ে তরবারি তৈরি করা হয়েছে। এখনো তা বুঝা যায় নি।"
তা ছাড়া হোনান জাদুঘরে আরো রয়েছে অনেক বিস্ময়কর জিনিস। ড্র্যাগন হচ্ছে চীনা জাতির প্রতীক। হোনান জাদুঘরে রয়েছে এই পর্যন্ত চীনের আবিষ্কৃত সবচেয়ে আগে নির্মিত ড্র্যাগনের চিত্র। ঝিনুকের খোল দিয়ে সাজানো ড্র্যাগনের চিত্র হোনানের ফুইয়াং নামক এক জায়গার কবরে আবিষ্কৃত হয়েছে। এর ইতিহাস প্রায় ৬৫০০ বছরের। এর জন্য কোন কোন প্রত্নতাত্বিক অনুমান করেন যে, সেই কবরের ব্যক্তি চীনা জাতির পুর্বপুরুষ হায়াং সম্রাট হতে পারে।
হোনান জাদুঘর তার সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষিকা কিম মিন আর এখানকার অমূল্য পুরাকীর্তিগুলো দেখার জন্য তার ছাত্রছাত্রীদের এখানে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, "হোনান জাদুঘরে সংরক্ষিত এই ঐতিহাসিক পুরাকীর্তিগুলো ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান অর্জনের জন্য খুব ভালো। ভবিষ্যতে সুযোগ থাকলে আমি আবার এখানে আসবো।"
বন্ধুরা, আপনারা হোনান যাদুঘরে আসলে কেবল পুরাকীর্তি দেখতে পাবেন তাই নয়, বরং এখানে প্রাচীনকালের সংগীতও শুনতে পাবেন। হোনান জাদুঘরের বৈশিষ্ট্যময় প্রাচীন সংগীত পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। প্রাচীণ সংগীত বাজানোর জন্য ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র সবই মূল্যবান পুরাকীর্তির অবিকল প্রতিরূপ। প্রাচীণ সুরের সাথে সাথে পর্যটকরা যেন প্রাচীনকালের আমেজে নিমগ্ন হয়ে যায়।
বন্ধুরা, এতোক্ষণ আপনারা হোনান জাদুঘরের ওপর বিস্তারিত জানলেন। এবার জেনে নিন এর পরিদর্শন মূল্য। হোনান জাদুঘরে প্রবেশ টিকিটের দাম মাত্র ২০ ইউয়ান রেনমিনপি । প্রাচীণ সংগীত পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করলে পৃথকভাবে পয়সা দিতে হয় না। আশা করি, ভবিষ্যতে আপনারা হোনান প্রদেশের রাজধানী চাংচৌ শহরে আসলে অবশ্যই এ জাদুঘরে যাবেন।
|