আপনারা এতক্ষণ যা শুনেছেন , তা চীনের অন্যতম সংখ্যালঘু জাতি- ই জাতির একটি ঐতিহ্যিক লোক সংগীত্ । গানের সুর এত মধুর হওয়ায় এই জাতির মধ্যে জনপ্রিয়তা হয়ে উঠেছে । দীর্ঘকাল ধরে চীনের বহু সংখ্যক সংখ্যালঘু জাতির মধ্যে ই জাতি তার অনন্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যিক উত্সবের বৈশিষ্ট্যের জন্য ব্যাপক পর্যটকদের আকর্ষণ করে । সম্প্রতি সি আর আই-এর নিজস্ব সংবাদদাতা ই জাতির এই গ্রামে সাক্ষাত্কার নিয়েছেন । তখন গ্রামে ই জাতির জাঁকজমকপূর্ণ ও ঐতিহ্যিক উত্সব-মশাল উত্সব পালিত হচ্ছিল । আজ এই অনুষ্ঠানে এ উত্সব সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলছি আমি…
ই জাতির লোকেরা প্রধানতঃ দক্ষিণ পশ্চিম চীনের ইউনান , সি ছুয়ান , কুই চৌ , কুয়াংসি প্রভৃতি প্রদেশ ও অঞ্চলে থাকেন । তারা বংশপরম্পরায় পাহাড়ের উপত্যকায় পরিশ্রম করেন এবং বংশ বিস্তার করেন । মনোরম ভূমিতে ই জাতির সুদূর ইতিহাস আর সরল ও নানা ধরনের সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছে । তাদের নিজেদের কথ্য ও লিখিত ভাষা আছে । তারা স্ববৈশিষ্ট্যসম্পন্ন লোক সংগীত্ ও নৃত্য সৃষ্টি করেছেন । সূচিকর্ম , ভাস্কর্য ও চিত্রকর্মে তারা পারদর্শী ।
চীনের ঐতিহ্যিক চন্দ্রবর্ষের ষষ্ঠ মাসের ২৪ তারিখ ই জাতির সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ উত্সব- মশাল উত্সব পালিত হচ্ছিল । সে দিন সংবাদদাতা কুই চৌ প্রদেশের ল্যু পিয়ান সুই শহরের সুই ছেং জেলার লাং চি গ্রামে সাক্ষাত্কার নিচ্ছিলেন । গ্রামের সামনে ও কৃষি ক্ষেতে সর্বত্র আনন্দিত মানুষ দেখা যাচ্ছিল । উদার আর স্বাস্থ্যবান পুরুষরা কুস্তি, ঘোড়দৌড় , ষাঁড়ের লড়াই ইত্যাদি ক্রীড়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন । লাবণ্যময়ী ই জাতির মেয়েরা উত্সবের রঙবেরঙের পোষাক পরে লোক সংগীত গাইছেন এবং বৈচিত্র্যময় নাচ করছেন । বাচ্চারা নির্বিঘ্নে ও স্বাচ্ছন্দ্যে আমোদ প্রমোদ করছে , এই অসীম আনন্দ উপভোগ করছে ।
ই জাতির মেয়ে লান আই চ্যু সংবাদদাতাকে বলেছেন , আগুণ উজ্জ্বলতার পরিচায়ক । ই জাতির প্রচুর উত্সবের মধ্যে মশাল উত্সব সবচেয়ে আড়ম্বরপূর্ণ বলা যায় ।
মশাল উত্সব ই জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী উত্সব । এই উত্সব উপলক্ষে ই জাতির লোকেরা নানাবিধ উদযাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ।
মশাল উত্সব সম্পর্কে বহু রূপকথা প্রচলিত আছে । ই জাতির বৃদ্ধ লিউ ইউয়ান লুং তার শৈশবে প্রচলিত একটি রূপকথা অবহিত করলেন ,
অনেক আগের কথা । স্বর্গে একজন হিংস্র দেবতা ছিলেন । জনতার কাছে খাজনা ও কর আদায় করার জন্য স্বর্গীয় রাজা তাকে দুনিয়ায় পাঠালেন । তার নির্যাতনে ই জাতির জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিল । ই জাতির একজন বীর তাকে হত্যা করলেন । স্বগীয় রাজা খুব রেগে গেলেন । কৃষকদের ফসল গ্রাস ও নষ্ট করার জন্য তিনি কীট পতঙ্গ পাঠালেন । কৃষকদের ফসল নিঃশেষে বিনষ্ট হওয়ার আশংকা দেখা দিল । এই মুহূর্তে ই জাতির লোকেরা ধানের গাছ দিয়ে মশাল বানিয়ে ক্ষতিকর পোকা পুড়িয়ে মারলেন । ফসল পোকার কবল থেকে রক্ষা পেল । পরে প্রতি বছরের এই দিনে ক্ষতিকর পোকা তাড়িয়ে দেয়ার জন্য মশাল জ্বালানো হয় । এই উপায়ে প্রাচুর্যময় ফসল পাওয়ার মঙ্গলকামনা করা হয় ।
কুই চৌ প্রদেশের সুই ছেং জেলার সংখ্যালঘু জাতি বিষয়ক কর্মকর্তা সি সু তে সংবাদদাতাকে বলেছেন , ই জাতির মশাল উত্সব বংশপরম্পরায় চলে আসছে । এতে এই জাতির আরো বেশী স্ববৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ও বিচিত্র বিষয়বস্তু ফুটে উঠেছে ।
পাহাড়ে কোনো কোনো তরুণ-তরুণী লোক সংগীত গাইল , কেউ কেউ শরীর চর্চা করল , ষাঁড় , মুর্গী ও ছাগল লড়াইয়ে যোগ দিল । উত্সব উদযাপনে অফুরন্ত উত্সাহব্যঞ্জক পরিবেশ বিরাজমান ছিল ।
মশাল উত্সব উপলক্ষে গ্রামের সকল লোকের মশাল জ্বলছে । তারা কৃষি ক্ষেত একবার প্রদক্ষিণ করে প্রচুর ফসল পাওয়ার মঙ্গলকামনা করলেন । দূর থেকে তাকালে প্রচুর মশাল অগ্নি-ড্রাগনের মতো আঁকাবাঁকাভাবে চলছে । ঝলমল করছে । তার পর গ্রামের মহাচত্বরে মশাল দিয়ে একটি অগ্নি-প্যাগোডা স্তূপীকৃত হয়েছে । লোকেরা অগ্নি-প্যাগোডার চার দিক ঘিরে নাচলেন । মহাচত্বর আনন্দফুর্তিতে ভরা । পরে তরুণ-তরুণীরা অরণ্যে পরস্পরের গান গাইল , প্রেম ও সুখী জীবনের মঙ্গলকামনা করল ।
রঙবেরঙের জামা-পোষাক পরায় উত্সব যেন ই জাতির একটি বিরাটাকারের পোষাক প্রদর্শনী হয়ে দাঁড়াল । এতে অন্তরঙ্গ ও আনন্দময় পরিবেশ রূপ পেয়েছে । স্থানীয় সংখ্যালঘু জাতি বিষয়ক একজন কর্মকর্তা শি সু ছেং বলেছেন , আগে গ্রামের চাষাবাদ ও জীবনধারণের ব্যবস্থা পশ্চাত্পদ ছিল । মশাল উত্সব উদযাপন কার্যক্রম আজকের মতো এত জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না । এখন গ্রামবাসীরা স্বচ্ছল হয়েছেন । তাই তাদের উদযাপন কার্যক্রম বৈচিত্র্যময় হয়েছে ।
আগে গ্রামবাসীরা দরিদ্র ছিলেন বলে মশাল উত্সবে চিত্তাকর্ষক দৃশ্য খুব কম দেখা যেতো । এখন তারা সমৃদ্ধ হয়েছেন । তাই সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে তাদের এই ঐতিহ্যবাহী উত্সবের উদযাপন ক্রমশঃ পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠেছে ।
মশাল উত্সবকে কেন্দ্র করে ই জাতির জীবনধারা অনেক সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে । লোকেরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের শিল্পকলার প্রতিভা বা বিবিধ নৈপুণ্য দেখাচ্ছেন । এতে অল্পবয়সীর অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্যও একটি শ্রেষ্ঠ সুযোগ পাচ্ছে ।
ই জাতির স্ববৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ক্রীড়া চর্চা , সংস্কৃতি ও চালচলনের প্রতিফলন হিসেবে মশাল উত্সব ধাপে ধাপে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে । দেশ-বিদেশে মশাল উত্সব অধিক থেকে অধিকতর খ্যাতনামা হচ্ছে । এই উত্সব বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করছে । ই জাতির মশাল উত্সবসহ বিচিত্র শোভাপূর্ণ আচার ব্যবহার জীবন্ত হয়ে উঠছে ।
|