২০০৬ সালের ১৩ জুলাই চীনের চিরিন প্রদেশের সিফিং শহরের কেন্দ্রীয় হাসপাতালের এক অপারেশন রুমের বাইরে অনেক সংবাদদাতা উপস্থিত ছিলেন । চিলিন টেলিভিশন কেন্দ্র সরাসরি এক অপারেশন সম্প্রচার করবে। ২৪ বছর বয়সী এক সাধারণ মেয়ে অপারেশনের অপেক্ষায় আছে । এক অপারেশন কেন এত আকর্ষণীয় ?কেন সবাই অপারেশনের জন্য প্রস্তুত একটি মেয়েকে এত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন ?
মেয়েটির নাম সুং ইয়ুলিং । তার ২৪ বছরের অনন্য ইতিহাসের কারণে লোকেরা তাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছেন । ১৯৮২ সালে হেইলুংচিয়াং প্রদেশের লুংচিয়াং জেলায় সুং ইয়ুলিংয়ের জন্ম হয় । প্রায় তার একই সময়ে জন্ম হয় তার চেয়ে মাত্র কয়েক মিনিট বড় জমজ বোন সুং চিনলিং । ৪ বছর পর বাবা-মার বিবাহবিচ্ছেদে দুই জমজবোনের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যায় । বাবা ছোটো বোন সুং ইয়ুলিংকে নিয়ে চিলিন প্রদেশের সিফিং শহরের লিসু জেলায় জীবনযাপন করতে শুরু করেন এবং তিনি আবার বিয়ে করেন । পক্ষান্তরে মা বোড় বোন সুং চিনলিংকে নিয়ে হেইলুংচিয়াং প্রদেশের লুংচিয়াং জেলায় বসবাস শুরু করেন এং পরে সিংশান থানার এক কৃষকের সঙ্গে তার বিয়ে হয় । এর পর থেকেই দুই বোন পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা । সত্ মা প্রায়ই ছোটো বোন সুং ইয়ুলিংকে মারপিট করতেন । তাই বাল্যকালে ইয়ুলিংয়ের মোটেও সুখ ও আনন্দ ছিল না । ১২ বছর বয়সে একদিন তার অসাবধানতার কারণে বাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙ্গে যায় । ভয়ে ইয়ুলিং কীটনাশক ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে । ডাক্তার তাকে বাঁচিয়ে তোলেন । এর পর ইয়ুলিং স্কুল চ্যুত হয়ে গ্রামে দাদীর সঙ্গে জীবনযাপন করতে শুরু করে । আপন মা ও জমজ বোনের কথা সবসময়েই ইয়ুলিংয়ের মনে পড়ে ।সে মনেমনে মা ও বোনের সঙ্গে দেখা করার স্বপ্ন দেখতে এবং বারবার বাবাকে মা ও বোনকে খোঁজার জন্য অনুরোধ করত । কিন্তু বাবা শুধু"পরে খুঁজব"একই উত্তর দিতেন । ইয়ুলিং বাবার কথা আর বিশ্বাস করে না ।
১৪ বছর বয়সের সময় সুং ইয়ুলিং বুড়ো দাদীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মজুরি করতে শহরে যায় । সে উপার্জন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে । কারণ সে মনে করে যে , টাকাপয়সা থাকলে সে মা ও জমজ বোন খুঁজে বের করতে পারবে । ১০ বছর ধরে ইয়ুলিং সেন ইয়াং,ছাংছুন আর কুয়াংচৌ শহরে মজুরি করেছে। পরিবারপরিজনদের ছেড়ে একা বাইরে মজুরি করতে যে কত কষ্ট হয় তা শুধু ইয়ুলিং নিজেই জানে । তাই সমবয়সী মেয়ের চেয়ে ইয়ুলিং নিজের জীবনকে অনেক মূল্যবান মনে করে । কিন্তু ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে এক নতুন দুঃখ আর কষ্ট তার ওপর বর্তায়।
ইয়ুলিংয়ের অসুখ হল । হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করে জানল যে, সে ইউরেমিয়ায় আক্রান্ত । ইয়ুলিং প্রথমবারের মতো মৃত্যুকে অনুভব করল । ইউরেমিয়ার উত্তম চিকিত্সা-পদ্ধতি হল কিডনি পরিবর্তন করা । কিডনি পরিবর্তন করতে চাইলে সর্বপ্রথমে উপযুক্ত কিডনি দরকার এবং চিকিত্সার জন্যে বিরাট অংকের টাকাপয়সা দরকার । ইউরেমিয়ায় আক্রান্ত মেয়েকে দেখে বাবা সুং তিয়েনজুন অত্যন্ত অনুতপ্ত ও অস্থির হয়ে ওঠেন। এই সময়ে আরেক জমজ মেয়ে সুং চিনলিংয়ের কথা বাবার মনে পড়ল ।
২০০৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী জটিল মনোভাব নিয়ে বাবা সুং তিয়েনজুন আরেক জমজ মেয়ে সুং চিনলিংকে খুঁজতে রওয়ান হলেন । তিনি জানেন না , সামনে তার কি সম্মুখীন হবে । তিনি জানেন না , তখন অনেক বছর ধরে তার মনে লুকায়িত গোপন কথা তিনি বলতে পারবেন কি না । সুং তিয়েনজুন তার মেয়েদের জন্মস্থানে ফিরে গেলেন । নানা উপায়ের মাধ্যমে তিনি তার বড় জমজ মেয়ে সুং চিনলিং ও তার মার খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করেন । অবশেষে সুং তিয়েনজুন নিজের চাচাতো ভাইর সাহায্যে বড় মেয়ে সুং চিনলিং ও তার মার খোঁজ পেলেন । ব্যাপার হল এই যে , চার বছর বয়সের পর সুং চিনলিংয়ের নাম পরিবর্তন হয় । বিশ বছর বয়সে সে অন্তর্মঙ্গোলিয়ার সিংআন জেলায় যায় এবং সেখানে বিয়ে করে । যখন তার বাবা এখানে সেখানে তার খোঁজখবর নিচ্ছিলেন তখন সে তিন বছর বয়সের এক সন্তানের মা ।
অনেক চেষ্টার পর সুং তিয়েনজুন অবশেষে বড় মেয়ে সুং চিনলিনকে পেলেন । সুং তিয়েনজুন বড় মেয়ে চিনলিংকে ইয়ুলিংয়ের অবস্থা জানালেন এবং চিনলিং নিজের একটি কিডনি বোনকে দান করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন । এমন এক আকস্মিক অনুরোধের সম্মুখীন হয়ে চিনলিং বিব্রত হল ।সে বলল,বিষয়টি বিবেচনা করতে তার সময় লাগবে ।
সুং ইয়ুলিংয়ের অবস্থার অবনতি হল । বাধ্য হয়ে সুং তিয়েনজুন আরেকবার অন্তর্মঙ্গোলিয়ায় যান । অন্তর্মঙ্গলিয়ায় পৌঁছুলে সুং তিয়েনজুন চিনলিংয়ের শ্বশুর-শ্বাশুরির সঙ্গে পরামর্শ করার সিদ্ধান্ত নিলেন । তিনি চিনলিংয়ের শ্বশুর-শ্বাশুরিকে ইয়ুলিংয়ের গল্প ও তার বর্তমান অবস্থা শোনালেন এবং চিনলিং একটি কিডনি ইয়ুলিংকে দান করে তাকে বাঁচানোর অনুরোধ জানালেন । কিন্তু চিনলিংয়ের শ্বশুর স্পষ্ট ভাষায় তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন । উপায় না থাকায় সুং তিয়েনজুন জামাইর সামনে উবু হয়ে বসলেন । এক পাশে আছেন স্বামীর সামনে উবু হয়ে বসা আপন বাবা আর অন্য পাশে আছেন নিরবে থাকা স্বামী দেখে সু চিনলিং আরও অস্থির হয়ে উঠল । বাধ্য হয়ে চিনলিং বাবাকে প্রথমে বাসায় ফিরে যেতে বললেন । যাতে নিজেই আবার স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন ।
অবশেষে সুং চিনলিং নানা চাপে স্বামী ও শ্বশুর-শ্বাশুরিকে রাজী করিয়ে ছোটো বোনকে এক কিডনি দান করার সিদ্ধান্ত নিল । ২০০৬ সালের ২২ জুন চিনলিং অন্তর্মঙ্গোলিয়া থেকে সিপিং অভিমুখী ট্রেনে উঠল । এটাই ছাড়াছাড়ি হওয়ার ২০ বছর পর দুই জমজ বোনের দ্বিতীয়বার সাক্ষাত । এই দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের পর বড় বোন নিজের একটি কিডনি ছোটো বোনকে দান করবে । চিনলিং বলল, " গত ২০ বছরে ইয়ুলিংয়ের যা হারিয়েছে আমার এই কিডনির দানে ইয়ুলিং তার সবই ফেরত পাবে । এটা হল ছোটো বোনকে আমার দেয়া উপহার ।
দুই বোনের দুই পরিবারের আর্থিক অসুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে সিপিং শহরের কেন্দ্রীয় হাসপাতাল ইয়ুলিংয়ের শল্যচিকিত্সার খরচ কমিয়ে দিল এবং হাসপাতালের মাধ্যমে চাঁদা সংগ্রহ করল । তাছাড়া স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে সুং ইয়ুলিং লিসু জেলার ছাওইয়াং আবাসিক এলাকা,বেসামরিক বিষয়ক সংস্থা,দারিদ্র্য বিমোচন সংস্থা, সিপিং শহরের রেড ক্রস সোসাইটি, পরিবেশ রক্ষা সংস্থার আর্থিক সাহায্যও পেয়েছে । ২০০৬ সালের ১৩ জুলাই দুই জমজ বোনের মধ্যে কিডনি পরিবর্তনের শল্যচিকিত্সা সিপিং শহরের কেন্দ্রীয় হাসপাতালে হল । ৫ ঘন্টা পর কিডনি পরিবর্তনের শল্যচিকিত্সা সাফল্যের সঙ্গে শেষ হয়েছে ।
|