দেশের অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন বজায় রাখার জন্য চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক--পিপলস ব্যাংক চীনা মুদ্রা রেনমিনবি'র আমানত ও ঋণের সুদের হার ০.২৭ শতাংশ বাড়িয়েছে । এটা চলতি বছরে এই ব্যাংকের দ্বিতীয় বার সুদ বৃদ্ধি। পুঁজিবিনিয়োগ ও ঋণ বৃদ্ধির মাত্রাতিরিক্ত গতি খর্ব করাই এবারের সুদ বাড়ানোর প্রধান উদ্দেশ্য। তা'ছাড়া সুদের হার বাড়ানোর ফলে যাতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত না হয় ,তার ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।
চলতি বছরের শুরু থেকে চীনের অর্থনীতি বরাবরই ১০ শতাংশেরও বেশি হারে বেড়ে চলেছে। স্থাবর সম্পত্তিতে পুঁজি বিনিয়োগ আর রপ্তানী হলো দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। চলতি বছরের প্রথম ছ'মাসে স্থাবর সম্পত্তিতে পুঁজিবিনিয়োগ প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ৬ মাসেই সারা বছরের জন্য নির্ধারিত ঋণ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রার৯০ শতাংশ প্রদান করেছে। উচ্চমাত্রায় পুঁজি বিনিয়োগ এবং ঋণ প্রদানের ফলে কোনো কোনো অপ্রয়োজনীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান অন্ধভাবে সম্প্রসারণ করা হয়েছে । এতে চীনের অর্থনৈতিক কাঠামোর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং শক্তিসম্পদ সরবরাহ কঠিন হয়ে পড়ে । ফলে অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের ক্ষমতা কমে যায়। তাই চলতি বছরের এপ্রিলে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক চীনা মুদ্রা রেনমিনবি'র ঋণের সুদের হার ০.২৭ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। তার পর ব্যাংকে রেনমিনবি'র আমানতের সুদের হারও দু'বার বাড়ানো হয়েছে।
এবারকার সুদের হার বৃদ্ধি প্রসঙ্গে চীনের ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ শিয়া পিন বলেছেন, "সুদের হার বাড়ানোর ব্যবস্থা এমন সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অবলম্বন করা হয়েছে যে, চীনে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এবং মুদ্রার সরবরাহ বেশ দ্রুতভাবে বেড়ে চলেছে এবং পুঁজি বিনিয়োগও কিছুটা বেশি দ্রুত বেড়েছে । অর্থনীতির স্থিতিশীল উন্নয়ন সুনিশ্চিত করার জন্য সুদের হার বাড়ানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।"
সুদের হার বৃদ্ধির ফলে ঋণ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের আসল খরচ বেড়ে গেছে,, এতে পুঁজি বিনিয়োগের উত্সাহ কিছুটা কমে যাবে। ফলে পুঁজি বিনিয়োগ ও ঋণ বৃদ্ধির মাত্রাতিরিক্ত গতি সীমাবদ্ধ রাখা যাবে।
এপ্রিল মাসের তুলনায় এবারকার সুদ বাড়ানোর ব্যবস্থা কিছুটা ভিন্ন।
প্রথমত, এপ্রিল মাসের সুদের হার বৃদ্ধির ব্যবস্থায় শুধু ঋণের মূল সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, পক্ষান্তরে এবার আমনত ও ঋণ উভয়ের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এর অর্থ জনগণের দীর্ঘমেয়াদী আমানতের সুদ বেশি পাওয়া যাবে। সুদের হার বৃদ্ধির পর চীনের অনেক লোক নিজেদের টাকা ব্যাংকে জমা রাখবেন। সুদের হার বৃদ্ধির দ্বিতীয় দিনে পেইচিংয়ের একটি শাখাব্যাংকে সংবাদদাতা দেখেছেন, শত শত লোক টাকা জমা রাখতে এসেছেন। ব্যাংক-কর্মী মিস লিউ ইং বলেছেন, "গত কাল ছিল সুদ বৃদ্ধির প্রথম দিন । অনেকে হয়ত খবর পান নি, তাই ব্যাংকে আসেন নি। আজ খুব বেশি লোক ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে এসেছেন।"
চীনের নতুন বাড়ির দাম ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ঋণের সুদের হার বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ক্রেতার উপকারের জন্য ঋণের মূল সুদের হারে ১৫ শতাংশ ডিস্কাউণ্ট দেয়া হয়েছে। চীনের ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ শিয়া পিন বলেছেন, " সংক্ষেপে বলতে গেলে , জনসাধারণের নতুন বাড়ি কেনার সুবিধার জন্য ঋণের সুদের হার কমিয়ে দেয়া হয়েছে" ।
চীনের ব্যাংকগুলো সুদ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক নাগরিককে প্রথম বাড়ি কেনার ব্যাপারে সবচেয়ে সুবিধাজনক সুদের হারে ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সাংবাদিক লি লেই মনে করেন, ঋণের সুদের হার বাড়ানোর মাত্রা এখনও সহ্য ক্ষমতার ভেতরে রয়েছে। তিনি বলেছেন, "আমি মনে করি, এই ব্যবস্থার ক্ষতি নেই। কারণ প্রতি মাসে বাড়ি কেনার ঋণ শোধ করার নির্দিষ্ট পরিমাণ বেশি নয় বলে বেশি চাপ সৃষ্টি হয় না।"
তবে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মী স্যু উয়ুন থিং বলেছেন, বাড়ি কেনার সময়ে তিনি যে ঋণ নিয়েছেন, তার মেয়াদ শেষ হবার আগেই তিনি এই ঋণ পরিশোধ করতে চান। তিনি বলেছেন, " নির্ধারিত সময়ের আগেই আমি ঋণ শোধ করতে চাই। কারণ ঋণের সুদের হার খুব উঁচু, আমি তো ব্যাংকের কাছে ঋণী । যথা সম্ভব অল্প সময়ের মধ্যেই তা পরিশোধ করতে চাই।"
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোর যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা আন্তর্জাতিক সমাজের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছে। কেউ কেউ মনে করেন, চীনের ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়ানোর নতুন সময়পর্বে প্রবেশ করেছে। পরবর্তীকালে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক " ঘন ঘন এবং অল্প মাত্রায় সুদের হার বাড়ানোর নীতি অবলম্বন করবে এবং অবিরামভাবে মুদ্রা নীতি দিয়ে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। এ প্রসঙ্গে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ শিয়া পিন মন্তব্য করেন, ভবিষ্যতে সুদ বাড়ানো হবে কি-না এবং সুদ বাড়ার মাত্রা কতটা হলে ঠিক হবে, তা সামষ্টিক অর্থনীতির পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। তিনি বলেছেন, "তা গোটা অর্থনীতির সামষ্টিক নিয়ন্ত্রণের মাত্রা আর কার্যকরিতার ওপর নির্ভর করবে। সুদ বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় আমানতের জন্য রিজার্ভ তহবিলও বাড়ানো হবে এবং নতুন প্রকল্পের পরিবেশ সংরক্ষণ এবং শক্তিসম্পদসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ সাশ্রয় ক্ষেত্রে পরীক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে । এমন সম্ভাবনা বাদ দেয়া যাবে না। যদি এ-সব ব্যবস্থা জোরদার করা হয়, তা'হলে ঘন ঘন সুদ বাড়ানোর আর দরকার হবে না । অর্থাত্ চীন সুদ বাড়ার সময়পর্বে প্রবেশ করবে না।"
|