চীনের দক্ষিণপূর্ব উপকূলের একটি প্রদেশের নাম ফুচিয়েন। বহির্বিশ্বের কাছে এই প্রদেশ ২৭ বছর আগেই উন্মুক্ত করা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এই প্রদেশের উন্নয়নের গতি অন্যান্য উপকূলীয় প্রদেশের চেয়ে কম। চীনের নতুন পাঁচসালা উন্নয়ন কর্মসূচির মেয়াদে ফুচিয়েন প্রদেশ আবার উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে ।
ফুচিয়েন প্রদেশ তাইওয়ান প্রণালীর পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। প্রণালীর পূর্ব দিকেই তাইওয়ান। হংকং এবং ম্যাকাও থেকেও ফুচিয়েন বেশি দূর নয়। সেজন্যে বাইরে থেকে পুঁজি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য এখানে সুবিধা খুব বেশি। গত শতাব্দির সত্তরের দশকের শেষ দিকে চীনে সংস্কার ও উন্মুক্ততার নীতি প্রবর্তনের পর প্রথম দিকে এই প্রদেশে বাইর থেকে অনেক পুঁজি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয় । কিন্তু পরের ২০ বছরে প্রতিবেশী কুয়াংতোং প্রদেশের তুলনায় ফুচিয়েন প্রদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পিছিয়ে পড়ে। ২০০৫ সালে কুয়াংতোং প্রদেশের জিডিপি ছিল ২৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, কিন্তু ফুচিয়েন প্রদেশের শুধু ৮১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এমনকি কুয়াংতোং প্রদেশের তুলনায় ফুচিয়েন প্রদেশে তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের পুঁজিবিনিয়োগও কম হয়েছে।
ফুচিয়েন প্রদেশের সামাজিক বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালক ইয়েন চেং মনে করেন, প্রথম দিকে ফুচিয়েন প্রদেশ যে তাইওয়ানী পুঁজি আকৃষ্ট করতে পেরেছে, তার কারণ প্রধানত তাইওয়ানবাসীদের পূর্বপুরুষদের উত্পত্তি ফুচিয়েন প্রদেশ। সেই আত্মীয় সূত্রের সুবাদেই প্রথম দিকে ফুচিয়েন তাইওয়ানের পুঁজি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। তিনি বলেছেন, "ফুচিয়েন প্রদেশ হলো তাইওয়ানের সবচেয়ে কাছাকাছি একটি প্রদেশ। কিন্তু তাইওয়ানের সঙ্গে লোকজন ও পণ্য আদানপ্রদানের সরাসরী ব্যবস্থা না থাকায় প্রণালীর ওপার থেকে এপারে আসার সহজ পথ নেই , বরং হংকং হয়েই ঘুরে আসতে হয় । তাতে পরিবহণের খরচ বেড়ে যায়। সেজন্যেই তাইওয়ানী ব্যবসায়ীরা বরং হংকংয়ের নিকটবর্তী কুয়াংতোং প্রদেশেই বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করেন। তার আর একটি কারণ আছে যে, হংকং আর ম্যাকাওয়ের ব্যবসায়ীরা কুয়াংতোং প্রদেশের মুক্তা নদীর বদ্বীপে আগে থেকেই পুঁজি বিনিয়োগ করে আসছে, সেখানে ইতোমধ্যেই শিল্প উন্নয়নের জন্য বেশ ভাল পরিবেশ গড়ে উঠেছে। ৯০-এর দশকে তাইওয়ানের বড় বড় কোম্পানি সাংহাই শহরে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করেছে , কারণ সাংহাই হলো চীনের অর্থনৈতিক কেন্দ্র।"
আনন্দের ব্যাপার এই যে, চীনের নতুন পাঁচসালা উন্নয়ন কর্মসূচিতে তাইওয়ান প্রণালীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত ফুচিয়েন প্রদেশের উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই প্রদেশে প্রণালীর পশ্চিম তীরে বন্দরসমূহ নির্মাণ জোরদার করা হচ্ছে। ফুচিয়েন প্রদেশের উপকূলীয় তটরেখা মোট ৩৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এ দিক থেকে ফুচিয়েন প্রদেশ চীনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ফুচিয়েন প্রদেশের সম্মুখীন তাইওয়ান প্রণালীতে দেশী-বিদেশী জাহাজগুলো অতি ব্যস্ততার সঙ্গে চলাচল করছে। বর্তমানে এক লাখ থেকে তিন লাখ টনী মালবাহী জাহাজ ভিড়বার উপযোগী গভীর পানির জাহাজঘাট ফুচিয়েন প্রদেশের উপকূলে নির্মাণ করা হচ্ছে। আগামী ৫ বছরে বন্দর নির্মাণে প্রাদেশিক সরকার ৫.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পুঁজি বিনিয়োগ করবে। ২০১০ সালে এই প্রদেশের বন্দরগুলোতে মাল বোঝাই ও খালাসের মোট পরিমাণ হবে ৩০ কোটি টনেরও বেশি।
ফুচিয়েন প্রদেশের রাজধানী ফুচৌ শহরের নতুন বন্দরগুলো একটি গভীর পানির কণ্টেইনার বন্দর। এই বন্দর এলাকায় শক্তিসম্পদ, রাসায়নিক শিল্প এবং লজিস্টিক্স শিল্প গড়ে উঠছে। বন্দর এলাকার কর্মকর্তা ছাই ফুইয়ং বলেছেন, "আধুনিক শিল্পের উন্নয়নের জন্য কাঁচা মাল , উপকরণ আর শ্রমশক্তির খরচ বিবেচনা করতে হয়। তা'ছাড়া লজিস্টিক্স খরচের কথাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। নৌ পরিবহণের খরচ কম। তাই বন্দর এলাকায় শিল্প উন্নয়নের সুবিধা বেশি, কারণ এখানে শিল্প উত্পাদনের খরচ কমানো যায়। এই এলাকায় আমরা উপরোক্ত শিল্প ছাড়াও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে তুলছি।"
২০১০ সালে ফুচিয়েন প্রদেশে পেট্রো-রাসায়নিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শক্তিসম্পদ, গাড়িনির্মাণ, জাহাজ নির্মাণ ইত্যাদি শিল্প গড়ে উঠবে। বন্দর এলাকার শিল্প উত্পাদনের মোট মূল্য এই প্রদেশের মোট শিল্প উত্পাদনের ৪৫ শতাংশেরও বেশি হবে।
বন্দর এলাকার উন্নয়নে প্রচুর তাইওয়ানী পুঁজি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা হচ্ছে। তাইওয়ানের টেলিযোগাযোগ, জৈব-ওষুধ, প্রেসিশিন মেশিনারি ইত্যাদি হাইটেক শিল্প কোম্পানি ফুচিয়েন প্রদেশে কারখানা আর অফিস স্থাপন করেছে। তাইওয়ানের ইয়ৌতা ফটো-ইলেক্ট্রিসিটি গোষ্ঠী ফুচিয়েন প্রদেশের শিয়ামেন বন্দরনগরে হাইটেক উন্নয়ন এলাকায় মোট ৫০ কোটি মার্কিন ডলার পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। এই এলাকার পরিচালনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান সুন তাহাই বলেছেন,
"এই প্রকল্পের তাত্পর্য এই যে, তার মাধ্যমে এখানে ২০-৩০টিরও বেশি সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। ফটো-ইলেক্ট্রিসিটির আনুষঙ্গিত বিভিন্ন উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য এখানে উত্পাদন করা হবে। ইয়ৌতা গোষ্ঠী এ-সব পণ্যের চূড়ান্ত এসেম্বলিং কাজ করবে । এই প্রকল্প চালু হলে বার্ষিক উত্পাদন ক্ষমতা হবে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার আনুষঙ্গিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক উত্পাদন হবে তিন-চার বিলিয়ন ডলার ।
ফুচিয়েন প্রদেশের আবহাওয়া তাইওয়ানের মতো, এই কারণেও তাইওয়ানী ব্যবসায়ীরা এখানে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করেন। যেমন, বড় আকারের ফুলের বাগান কোম্পানি । তাইওয়ানী ব্যবসায়ী স্যু ছিইয়েন এখানে একটি ফুল বাগান ও বিক্রয় কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর বাগানে উত্পন্ন অর্কিড ফুল ইউরোপের বাজারে খুব বিক্রী হয়। তাঁর বাগানে ১৪ হাজার বর্গমিটার জমিতে অর্কিড ফুল চাষ করা হয়েছে। গত বছর তাঁর কোম্পানি কয়েক মিলিয়ন অর্কিড ফুল রপ্তানী করেছে। তিনি বলেছেন, "আমাদের তাইওয়ানের কৃষির উচ্চপ্রযুক্তির পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। চীনের মূলভূভাগের কৃষি তার ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে আর বেশি উন্নয়ন করা সম্ভব নয় । তাই তাইওয়ানের কৃষি প্রযুক্তি আমদানী করে কৃষিপণ্যের গভীর প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে তুলতে হবে, তাতে স্থানীয় কৃষকদের খুব উপকার হবে।"
|