উত্তর-পশ্চিম চীনের সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের আথুশি শহরের থুকুমেদি থানা আর কিরগিজ প্রজাতন্ত্রের মধ্যে শতাধিক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সীমান্তরেখা আছে । যারা এই সীমান্তরেখা রক্ষা করছেন , তাদের মধ্যে সীমান্ত রক্ষী সৈন্য ছাড়া কিরগিজ জাতির বহু পশুপালকও আছেন । আজ এই অনুষ্ঠানে সীমান্তরেখা রক্ষার দায়িত্ব পালনকারী কিরগিজ জাতির পশুপালক উসিমান সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলছি আমি…
উসিমান থুকুমেদি থানার ইদালিয়াং গ্রামের অধিবাসী । গ্রামে তার মতো মোট ন'জন সীমান্ত রক্ষী পশুপালক আছেন । তাদের মধ্যে পঞ্চাশ বছরেরও বেশী বয়স্ক উসিমান জ্যেষ্ঠ । তার প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সীমান্ত থানাকে সহায়তা করা , সীমান্ত অঞ্চলের তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনা করা এবং মানুষ ও গবাদি পশুর সীমান্ত পারাপার বন্ধ করা ।
বাবা থেকে আমার পরিবারের তিন প্রজন্মের লোক সীমান্ত রক্ষীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন । এখন আমার ছেলেও সীমান্ত রক্ষীর দায়িত্ব পালন শুরু করেছে ।
উসিমান ও তার পরিবার পরিজন যে সীমান্ত রক্ষীর দায়িত্ব পালন করেন , তা অর্ধ শতাব্দিরও বেশি । থুকুমেদি থানার নিকটবর্তী সীমান্তরেখায় ২২টি পাহাড়ী পথ আছে । এই সব পাহাড়ী পথের ভৌগলিক অবস্থান খুব জটিল । অনেক আগে থেকেই সামরিক ও বেসামরিক লোকেরা এই সীমান্তরেখা রক্ষা করতে শুরু করলেন ।
যখন উসিমানের বয়স ১৬ বছর , তখন থেকে তিনি বাবার সঙ্গে সীমান্তরেখা রক্ষার কাজ শুরু করলেন । তিনি বুতমুনাক নামক যে পাহাড়ী পথ রক্ষা করছেন , তা সমুদ্র-সমতলের তুলনায় ৫ হাজার মিটার উঁচু । এখানকার পরিবেশ আর আবহাওয়া খুব দুরূহ । গ্রীষ্মকালেও তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি । উসিমান এই পাহাড়ী পথ ২৬ বছর পাহারা দিয়েছেন । এই সময়ের মধ্যে দুঃখ-কষ্ট এমন কি বিপদও প্রায়ই ঘটেছে ।
১৯ বছর আগে এক দিন যখন উসিমান ও তার পরিবার পরিজন পাহাড়ে পাহারা দিচ্ছিলেন , তখন তুষার পড়ছিল । তিনিসহ পরিবারের ৭ জন পাহাড়ের উপরে আটকা পড়লেন । তুষার অধিক থেকে অধিকতর ভীষণ হচ্ছিল । উসিমান ও পরিবার পরিজন খুব চিন্তিত পড়লেন । পঞ্চম দিনে তারা সবাই একেবারে নিরাশ হলেন । ঠিক এই সময় দূর থেকে বিমানের ইঞ্জিনের অস্পষ্টশব্দ শোনা যাচ্ছিল । উসিমানের স্ত্রী উয়ের রুছিন স্মরণ করে বলেছেন ,
তখন সরকার ও গণ মুক্তি বাহিনী হেলিকপ্টার পাঠিয়েছে । তারা আমাদের কাছে খাদ্য দ্রব্য আর পশু খাবার সরবরাহ করেছে ।ফলে আমারা সপরিবারে উদ্ধার পেয়েছে ।
উসিমান বলেছেন , এই আজীবন অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তার সীমান্ত রক্ষীর সংকল্প আরো দৃঢ় হয়েছে ।
সুতরাং আমি সরকারের উপকারের জন্য খুব ধন্যবাদ জানাই । এই উপকারের জবাবে সীমান্ত রক্ষীর দায়িত্ব আরো ভালভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা চালাবো ।
প্রতি বছরের জুন ও জুলাই মাসে উসিমান কাজে খুব ব্যস্ত আছেন । গ্রীষ্মকালীন পশু চারণভূমি পশুপালকদের আকর্ষণ করে । তখন বহু পশুপালক বুতমোনাক পাহাড়ী পথের আশেপাশে পশু চারণ করতে যান । অসাবধানে গরু ও ভেড়া সীমান্ত পার হতে পারে । পশুপালকদের সীমান্ত রক্ষীর আইন মেনে নেয়ার চেতনা উন্নত করার জন্য তিনি বিবিধ উপায়ে পশুপালকদের মধ্যে প্রচার কাজ শুরু করেন ।
বুতমোনাক পাহাড়ী পথের ভৌগলিক অবস্থা জটিল , পাহাড়ের উপরে অক্সিজেন কম । সাধারণ মানুষের জন্য এই পাহাড়ে আরোহণ করা খুব কঠিন । সুতরাং কেউ কেউ এই জায়গার মাধ্যমে সীমান্ত পার হওয়ার অপচেষ্টাও চালায় । গত বছরের মে মাসের এক দিন উসিমান বাড়ি ফিরছিলেন । এই সময় তিনি কয়েক জন অপরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা হলো । বহু বছর ধরে সীমান্ত রক্ষীর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী , এই কয়েক জন লোক সীমান্ত পার হওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে । সেজন্য তিনি তাড়াহুড়া করে ঘোড়ায় চড়ে সীমান্ত থানায় যান । পুলিশরা শীগ্গিরই বুতমোনাক পাহাড়ী পথের দিকে ছুটে যান এবং সীমান্ত পার হওয়া দু'জন অপরাধীকে গ্রেফতার করেন । বহু বছর ধরে উসিমান আর থানার পুলিশরা সীমান্ত পার হওয়ার জন্য মোট ৩৫জন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছেন ।
উসিমান কখনো কখনো সীমান্ত থানার পুলিশদের সঙ্গে পাহারা দেন । থানার পুলিশরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছেন । উত্সবে তিনি বাসায় তাদের দাওয়াত করেন । তিনি প্রায়ই থানার পুলিশদের খাসির মাংস খেতে দেন । পুলিশরা তাকে নিজেদের পরিবারের মত মনে করেন । পুলিশ ইয়ালিকুন বলেছেন ,
যখন আমাদের কাজের অসুবিধা হয় , তখন উসিমান আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের সাহায্য করে থাকেন । এতে আমরা খুব মুগ্ধ হয়েছি ।
ইয়ালিকুন স্মরণ করে বলেন যে , এক দিন পাহারা দেয়ার সময় তিনি হঠাত্ পেটে ব্যথা অনুভব করেন । তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যান । উসিমান ও আরেকজন পশুপালক পথের বাধা-বিঘ্ন কাটিয়ে তাকে পাহাড়ের নীচের একটি হাসপাতালে পাঠান । আসলে ইয়ালিকুন এপেনডিক্স রোগে আক্রান্ত হন । আরেকটু দেরি হলে তার মৃত্যুবরণের আশংকা ছিল । ইয়ালিকুন বলেন , উসিমান ও অন্যান্য পশুপালকরা তাকে বাঁচিয়েছেন ।
গত ২৬ বছর ধরে উসিমান অনবরতভাবে বরফে ঢাকা সীমান্তরেখায় পাহারা দিয়ে আসছেন । তার ৫ ছেলে আছে । কনিষ্ঠ ছেলেও সীমান্ত রক্ষীর কাজে অংশ নিচ্ছে ।
চীনে কিরগিজ জাতিকে সীমান্ত রক্ষী জাতি বলে অভিহিত করা হয় । পাহাড় বাবা আর পানি মা বলে তারা মনে করেন । তারা মাতৃভূমিকে ভাল বাসেন আর সম্মান করেন । তারা নিজেদের মাতৃভূমির প্রতি অশেষ আনুগত্য আর স্নেহ প্রকাশ করেন ।
|