চু চিয়াওয়েন উত্তর পূর্বচীনের ছাংছুন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বুদ্ধিমতী ছাত্রী । সবার চোখে তিনি ফুলের মতো সুন্দরী । সি ওয়েই ভাল গান গাইতে পারেন এবং চমত্কারভাবে বাদযন্ত্রও বাজাতে পারেন । কিন্তু গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তার চোখ দুটোর দৃষ্টি হারিয়ে গেছে । এক আকস্মিক সময়ে সুন্দরী মেয়ে চু চিয়াওয়েন সি ওয়েইর বাজানো সুর শুনতে পান এবং সঙ্গে সঙ্গে গভীরভাবে এই অন্ধ শিল্পীকে ভালবেসে ফেলেন । প্রচলিত রীতিনীতি উপেক্ষা করে অবশেষে দুই যুবক-যুবতীর মিলন হয়েছে । তাদের বিয়ে চিরকাল টিকে থাকতে পারবে তো ?
১৯৯১ সালে সি ওয়েই ছাংছুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে ভর্তি হন । চমত্কার গিটার বাজাতে পারেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কিছু দিন পর তার নাম দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়েসবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই কারণে সঙ্গীতপ্রিয়অনেক ছাত্রছাত্রী একের পর এক তার কাছে সঙ্গীত শিখতে আসেন । এক দিন চু চিয়াওয়েন নামে এক মেয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন । চু চিয়াওয়েন বিদেশী ভাষা বিভাগের শ্রেষ্ঠ ছাত্রী । তিনি শুধু সুন্দরী নন , তিনি সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমিতির চেয়ারম্যানও ছিলনে । সবাই তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরী ফুল বলে অভিহিত করেন । কিন্তু সে সময়ে সি ওয়েই এ সব জানেন না । এই সুন্দরী মেয়ের সম্মুখীন হয়ে সি ওয়েই অস্থির হলেন । অন্যের তুলনায় ভিন্ন চরিত্রের চু চিয়াওয়েন সি ওয়েইর দৃষ্টি আকর্ষণ করে । যখন সি ওয়েই মেয়েটির পরিচয় নিয়ে ভাবছিলেন তখন সেই মেয়েটি সি ওয়েইকে গিটারে সুর শোনানোর অনুরোধ জানান । মেয়েটির অহংকার দেখে তাকে পরাভূত করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মেয়েটি তার হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করেছে ।
ছোটো বেলা থেকেই সি ওয়েইর সঙ্গীতের প্রতিভা শুরু হয় । ৬ বছর বয়সে এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তার চোখ দুটোর দৃষ্টি প্রায় হারাতে বসেছে । তখন নিজের প্রতিভা ও আত্ম-প্রচেষ্টার পর সি ওয়েই সফল হন এবং সেই সময়ে বেশ কয়েকবার দেশীয় প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পান । সি ওয়েইর সঙ্গীতের প্রতিভার সামনে অংহকারী চিয়াওয়েন আর তাকে তুচ্ছ করে দেখতে পারেন না বরং তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে শুরু করেন । প্রথমবার সাক্ষাতের পর দুজনই পরস্পরের মনে ভাললাগার গভীর ছাপ ফেলে । এর পর চু চিয়াওয়েন বারবার আমন্ত্রিত হয়ে সি ওয়েইর সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশ নেন ।চোখের সমস্যা অন্ধদের জন্যে যে হীনতা সৃষ্টি করে চিয়াওয়েন সি ওয়েইর ভেতর তা অত্যন্ত কম দেখেন । চিয়াওয়েন ধীরে ধীরে চোখ দুটো প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার সি ওয়েইকে ভালবেসেছেন আর সি ওয়েইও চিয়াওয়েনের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছেন । অন্যান্য অনুরাগীদের সম্মুখে চু চিয়াওয়েন কোনো মতেই দ্বিধাগ্রস্ত নন । নিজের বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চিয়াওয়েন নিজের ভালবাসা গ্রহণ করতে পারবেন ? চিয়াওয়েনকে নিজের ভালবাসার কথা বলার মত আত্মবিশ্বাস ও সাহস সি ওয়েইর নেই ।
সি ওয়েইর ভালবাসা চিয়াওয়েন বুঝেছেন । যদিও তিনি মনে মনে তাকে প্রশংসনীয় দৃষ্টিতে দেখেন,তবু সি ওয়েইর জন্য তার কিছু চিন্তাও হয় । যখন চিয়াওয়েন দ্বিধাগ্রস্ত হছিল ঠিক এই সময়ে তার মনোভাব পরিবর্তনের ক্ষেত্রেএক ঘটনা ঘটল । সি ওয়েইর চোখ শুধু আলো দেখতে পারে । বিশেষ করে সন্ধ্যায় মাত্র অল্প আলো অনুভব করতে পারে । কিন্তু সন্ধ্যার ক্লাস শেষ হওয়ার পর যাতে অন্য ছেলেদের মতো মেয়েকে হলে পৌঁছাতে পারে সে জন্যে সি ওয়েই আলোপূর্ণ দিনে বারবার ক্লাস রুম থেকে হলে আসা যাওয়ার অনুশীলন করতে থাকেন । ক্লাস-রুম আর হলের মধ্যে ব্যবধান কম নয় , কমপক্ষেএকটি রাস্তা অতিক্রম করতে হয় । এটা সি ওয়েইর পক্ষে অভাবনীয় । কিন্তু "সুন্দরী ফুল" রক্ষীর কর্তব্য সম্পন্ন করার জন্যে সি ওয়েই নিজের স্মৃতি শক্তির উপর নির্ভর করে চিয়াওয়েনের হলে যাওয়ার পথ মনে রেখেছেন । চিয়াওয়েনকে হলে পৌঁছে দেয়ার পর সি ওয়েইকে রাস্তা পার হওয়ার বিপদের ঝুঁকি নিয়ে নিজের বাসায় ফিরতে হয় ।
ঘটনাটি চিয়াওয়েনকে অনেক বিস্মিত করেছে । সি ওয়েই দৃষ্টিঅক্ষম হলেও চিয়াওয়েনের চোখে সে এক সত্যিকারের পুরুষ । চিয়াওয়েন বিশ্বাসকরেন যে,সি ওয়েই তার দক্ষতা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে তার আশাকে পূরণ করতে সক্ষম হবে । অবশেষে চিয়াওয়েন সি ওয়েইর ভালবাসা গ্রহণ করেছেন । এর পর থেকে দুজন মধুর মতো প্রেমের জীবন যাপন শুরু করেন । দেখতে দেখতে দু বছর পার হয়ে গেলো । চিয়াওয়েনের বাবামা মেয়ের প্রেমের কথা জেনেছেন । পরিবারের সবাই চিয়াওয়েনের এ প্রেমের বিরোধিতা করেন এবং আতীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবরাও চিয়াওয়েনকে তার এই প্রেম ছেড়ে দেয়ার তাগিদ দেন ।
এ দিকে চিয়াওয়েনের মনোভাবের পরিবর্তনে সি ওয়েই অত্যন্ত চিন্ডিত । সি ওয়েই নিজের মনের কথা নিয়ে " চিরকালই তোমাকে ভালবাসব"নামক গানলিখে চিয়াওয়েনকে দান করেছেন । গানটি তাড়াতাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে যায়। চিয়াওয়েনের প্রতি সি ওয়েইর প্রেম তাদের দুজনের বাবামাকে মুগ্ধ করেছে । ১৯৯৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার এক বছর পর সি ওয়েই ও চিয়াওয়েনের বিয়ে হয় । বিয়ে হওয়ার পর চিয়াওয়েন আনহুই প্রদেশের হোফেইশহরের এক মাধ্যমিক স্কুলে ইংরেজী ভাষা শেখান । সঙ্গীতের প্রতিভা থাকলেও চোখের কারণে সি ওয়েই দীর্ঘ কাল ধরে কোন কাজ কাজ পাননি। খাওয়াদাওয়া ও থাকার সমস্যা না হলেও স্ত্রীর উপর নির্ভর করে জীবনযাপন করায় সি ওয়েই বিশেষভাবে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতেন ।
বারে গিয়ে গিটার বাজিয়ে গান গাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন সি ওয়েই । নিজের গানের প্রতিভা দেখিয়ে সি ওয়েইর নাম তাড়াতাড়ি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে । সি ওয়েইর নামের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণকরা লোকেরা তার গান শুনতে বারে আসেন। হোফেইশহরে সহজে গিটার পাওয়া যাবে না কথাটা শুনে সি ওয়েই মনে করেন যে , এটা একটি ভাল সুযোগ । তাই সিওয়েই স্ত্রী চিয়াওয়েনের সঙ্গে পরামর্শ করে এক গিটারের দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । অর্থ সংগ্রহ করার জন্যে সন্ধ্যার দিকে সি ওয়েই বারে গিয়ে গান শোনাতেন এবং দিনে নিজের গিটার দোকান চালাতেন । প্রথম দিকে বহুবিধ অসুবিধা থাকলেও নিজের অক্লান্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সি ওয়েইর ব্যবসা দিন দিন সম্প্রসারিত হতে থাকে। ২০০৪ সালে সি ওয়েই প্রায় দশ লাখ রেনমিনপি বিনিয়োগ করে তার দ্বিতীয় গিটারের দোকান খুললেন । ২০০৫ সালের শেষ দিকে সি ওয়েই ও চিয়াওয়েনের মেয়ের জন্ম হলে এই পরিবারের জন্যে আরও বেশি সুখশান্তি ও আনন্দ বয়ে আনে ।
|