পেইচিং থেকে দেড় শো কিলোমিটার উত্তরপূর্বে রয়েছে একটি আধুনিক নতুন শহর --থাংশান। এই শহরের চমত্কার অবকাঠামো আছে বলে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি এখানকার নতুন হাইটেক উন্নয়ন এলাকায় পুঁজি বিনিয়োগ করেছে।
৩০ বছর আগে ,অর্থাত্ ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই থাংশান শহর এবং তার আশেপাশের এলাকায় এক অতি ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটেছে। ভূমিকম্পের আঘাত এতোই প্রবল যে, তা জাপানের হিরোসিমা শহরে নিক্ষিপ্ত এটম বোমার চেয়ে ৪০০ গুণেরও বেশি । ভূমিকম্পে দশ লক্ষাধিক লোকসংখ্যা অধ্যুসিত থাংশান শহর মূহুর্তের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয়ে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তাতে ২.৪ লক্ষ লোক প্রাণ হারিয়েছেন এবং অন্য ১.৬ লক্ষ লোক গুরুতর ভাবে আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ১০ বিলিয়ন ইউয়ান। তখনকার চীনের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটা এক খুবই বড় অংক । এই ভূমিকম্পের প্রত্যক্ষদর্শী মাদাম ওয়াংকুইছিন বলেছেন, "ভুমিকম্পের আগে আমরা দু'তলা দালানের দু'তলায় থাকতাম। এই দালান ভুমিকম্পে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে । মাটি দেবে গেছে ,আমাদের দু'তলা বাড়ি ধসে একতলার মেঝের মতো নিচু হয়ে গেল। আমার ঘরের উত্তর দিকের একটি জানালা ভেঙে গিয়ে তাতে সৃষ্টি হলো এক আকাশমুখী ফুটো। আমরা এই ফুটো দিয়ে কোনো রকমে বেরিয়ে যেতে পারলাম। হাল্কা বৃষ্টি পড়ছিল। তখন আমাদের বাচ্চার বয়স মাত্র দু' বছর । আমরা সূর্যমুখীর বড় বড় পাতা এক সঙ্গে বেঁধে ছাতা হিসেবে ব্যবহার করলাম।"
লোকের মন থেকে এই ভয়াবহ দুর্যোগের স্মৃতি মুছে ফেলা যায় না। থাংশানের একটি প্রধান রাস্তার এক বিশেষ অংশে সেই ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তুপ এবং মাটি দেবে যাওয়ার চিহ্ন আজও অবিকৃত রাখা হয়েছে । কিন্তু এর উত্তর দিকে তাকালে একেবারে বিপরিত দৃশ্য দেখা যায় : সেখানে সারি সারি উঁচু দালান এবং মহা ইমারত মাথা উচিয়ে দাঁড়ি আছে এবং অবিরাম স্রোতের মতো আধুনিক গাড়ি চলাচল করছে।
সংবাদদাতা সেখানে জানতে পেরেছেন, ভূমিকম্পের পর ৩০ বছরে থাংশানবাসীদের আয় স্থিতিশীলভাবে দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। ২০০৫ সালে শহরবাসীদের আয় ভূমিকম্পপূর্ব ১৯৭৫ সালের তুলনায় ৪০ গুণ বেড়েছে। কম্পিউটার এবং শরীর গঠনসংক্রান্ত উপকরণ ছাড়াও বাসিন্দারা নতুন বাড়ি আর গাড়ি কিনছেন। খুব সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ দিনব্যাপী এক আন্তর্জাতিক গাড়ি মেলায় মোট ৪১০টি গাড়ি বিক্রী হয়েছে। তার মোট মূল্য প্রায় এক কোটি মার্কিন ডলার। এক জরীপ থেকে জানা গেছে, থাংশান শহরে প্রতি পাঁচ জনের জন্য গড়ে একটি প্রাইভেট গাড়ি আছে। থাংশান তোংফাং মেলা ব্যবস্থাপনা কোম্পানির কর্মী মাদাম ওয়াং মেই বলেছেন,
" থাংশান আন্তর্জাতিক গাড়ি মেলা হলো , আমাদের কোম্পানির প্রতিষ্ঠিত একটি 'মার্কা'। আমাদের পরিকল্পনা হলো প্রতি বছর একবার করে এ-রকম আন্তর্জাতিক মেলার আয়োজন করা। মেলাটি নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হবে, প্রতি বছরই এতে অগ্রগতি অর্জিত হবে । গত বছরের গাড়ি মেলায় আমাদের কোম্পানির শুধু ৭০টি গাড়ি প্রদর্শন করা হয়েছে,। এ বছরের মেলায় ১৪৯টি গাড়ি প্রদর্শন করা হয়েছে । আগে শুধু সস্তা দামের দেশী গাড়ি প্রদর্শন করা হতো । এখন উন্নত মানের বিদেশী গাড়িও প্রদর্শন করা হয়। গাড়ির দাম ৪০ হাজার ইউয়ান থেকে কয়েক মিলিয়ন ইউয়ান।"
৩০ বছরে থাংশানবাসীরা দুর্যোগজনিত দু:খদুর্দশা থেকে বেরিয়ে গৌরবের সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছেন । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে থাংশান শহরে বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগ অনবরত বেড়ে চলেছে। চলতি বছরের প্রথম ছ' মাসেই থাংশান শহরে ৩১ কোটি মার্কিন ডলার বৈদেশিক পুঁজি ব্যবহার করা হয়েছে, তা গত বছরের অনুরূপ সময়ের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি । থাংশান শহরের বাণিজ্য ব্যুরোর পুঁজি বিনিয়োগ বিভাগের পরিচালক ছাই হোং বলেছেন, "থাংশান একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পনগর । এই শহরের ঐতিহ্যিক শিল্প হলো লোহা ও ইস্পাত, নির্মাণসামগ্রী, যন্ত্র নির্মাণ ইত্যাদি শিল্প।যৌথ পুঁজি বিনিয়োগ , সহযোগিতা এবং শেয়ার হস্তান্তর ইত্যাদি পদ্ধতিতে প্রচুরসংখ্যক বহুজাতিক কোম্পানিকে এখানে পুঁজি বিনিয়োগ ও শিল্প স্থাপন করতে আকর্ষণ করা হয়েছে । জাপানের প্যানাসোনিক, টয়োটা, ফ্রান্সের ডানন, যুক্তরাষ্ট্রের আনহেউসার-বাশ, হংকংয়ের চেউংকং লিমিটেড, ইত্যাদি কোম্পানির সঙ্গে থাংশানের যৌথ বিনিয়োগ ও সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে ইস্পাত শিল্পে আমরা বিদেশের সঙ্গে যৌথ পুঁজি বিনিয়োগে ইস্পাত শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছি। ফলে সামগ্রিকভাবে আমাদের শহরের ইস্পাত শিল্পের প্রযুক্তি উন্নততর হয়েছে এবং পণ্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষমতাও বেড়েছে।"
তিনি জানিয়েছেন, থাংশান শহরের দক্ষিণ উপকূলের একটি জলসীমায় সহজেই ৩ লক্ষ টনী জাহাজ ভিড়বার উপযোগী জাহাজঘাট নির্মাণ করা যায়। এটা পেইচিং ও থিয়েনচিং মহানগর-সহ গোটা পোহাই উপসাগর অর্থনৈতিক অঞ্চলের একটি প্রধান বন্দর এবং উত্তরচীনের বিশ্ব-শ্রেণীর রাসায়নিক শিল্পের ঘাঁটি এবং জাতীয় ভারি শিল্পের 'সার্কুলার ইকোনমি'র আদর্শ এলাকায় পরিণত হবে। পেইচিং মহানগরের বৃহত্তম ইস্পাত কারখানাটিও এই এলাকায় স্থানান্তরিত হবে।
জাপানী পুঁজির থাংশান রিশেং যন্ত্র কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ইয়োশিকাওয়া থাংশানের পুঁজি বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ প্রসঙ্গে বলেছেন, "থাংশান শহরের সুবিধা অনেক বেশি। থিয়েনচিন এবং পেইচিং এই দুটো মহানগরের খুব কাছে অবস্থিত বলে থাংশান শহর এতো বেশি জাপানী কোম্পানিকে আকৃষ্ট করছে। অবশ্যই এখানে সুবিধা খুব বেশী । আমি মনে করি, এই শহরকে পুঁজি বিনিয়োগের স্থান হিসেবে বেছে নেয়াটা আসলেই ঠিক হয়েছে। এখানে লজিস্টিক্স আর পরিবহণের সুবিধা পাওয়া যায়, এখানকার 'ডেভেলপমেণ্ট জোন' আমাদের খুব সাহায্য করে। এই শহর খুব শান্ত ও পিরশীলিত। এখানকার মানুষ সরলমনা এবং খুব সাদাসিধে।"
২০০৫ সালে থাংশানের মোট জিডিপি বেড়ে ২৫.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। জনগণের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হচ্ছে। এই শহর একদিন এক সুষম, স্থিতিশীল ও আধুনিক শহরে পরিনত হবে।
|