৩০ বছরের আগেকার থাং শানের ভয়ংকর ভূমিকম্প চীনা লোকদের মনে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে । এই ভূমিকম্পে ২ লাখ ৪০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছে এবং ৪০ হাজার ছেলেমেয়ে অনাথ হয়ে দাঁড়িয়েছে । ৩০ বছর পার হয়ে গেছে । এসব অনাথ কিভাবে দিন কাটাচ্ছেন? সম্প্রতি আমাদের সংবাদদাতা তাদের কয়েকজনের সাক্ষাত্কার নিয়েছেন । আজকের অনুষ্ঠানে তাদের কাহিনী শোনাচ্ছি আমি শি চিং উ ।
এখন আপনারা যে ভদ্র মহিলার টেলিফোনের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন , তার নাম সুই ওই ওই । তিনি বেশ লম্বা । মুখে তার সবসময় হাসি থাকে । দেখামাত্র আপনি চিনতে পারবেন না যে , তার জীবনে তিনি মর্মান্তিক দু:খকষ্টের শিকার হয়েছিলেন । তবে ৩০ বছরের আগেকার ভূমিকম্পের কথা উল্লেখ করলে তিনি সেই অভিজ্ঞতার কথা আবেগ আপ্লুত কণ্ঠেস্মরণ করেছেন । তিনি বলেছেন ,
আমি নিশ্চয় সেই ভূমিকম্প ভুলতে পারি না । আজীবন আমি তা ভুলতে পারবো না ।
১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই ভোর ৩টা ৪২ মিনিটে পৃথিবীর স্পন্দন যেন থেমে গেল । হঠাত রিখটার স্কেলে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে । নিমেষের মধ্যে উত্তর চীনের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প নগর - থাং শান সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে গেল । এই ভূমিকম্পে ২ লাখ ৪০ হাজার লোক নিহত হন । তাদের মধ্যে সুই ওই ওইয়ের বাবামা ও এক বোন ছিল ।
ওই ওইয়ের একটি সুখী পরিবার ছিল । তার বাবা থাং শান লৌহ ও ইস্পাত কারখানায় কাজ করতেন এবং বেশ ভালো উপার্জন করতেন । তার মা টুপি তৈরির একটি কারখানায় কাজ করতেন । তাদের তিন বোন ছিল । ওই ওইয়ে ছিল সবচেয়ে কনিষ্ঠ । শিশু ওই ওইয়ের মেজাজ তেন ভালো ছিল না । সে সবসময় অভিমান করতো । রাগ হলে সে সর্বদাই দরজা বন্ধ করে অনাহারে থাকতো । প্রতিবার বাবামা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তাকে অনেক বুঝিয়ে অনুরোধকরতেন । ওই ওইয়ের মনে আছে, তার বাড়ির কাছে একটি বিভাগীয় বিপণী ছিল । ছুটির দিনে তার বাবা প্রায়সই তাকে নিজের কাঁধে তুলে দোকবাজারে নিয়ে যেতেন । সেই সময়ে তার মা সবসময় তার দুটো বোনের হাত ধরে তাদের অনুসরণ করতেন । কতই না একটি সুখী পরিবার ছিল তাদের ।
যেদিন ভয়ংকর ভূমিকম্প হলো , সেদিন অসম্ভব গরম ছিল । ওই ওইয়ের বড় বোন বাইরে সহপাঠীদের সংগে ব্যাডমিনটন খেলার পর ভোর ১টার দিকে বাড়িতে ফিরলেন । তাদের তিন বোন একটি ঘরে থাকতেন । ওই ওই ও তার মেজ বোন একটি বড় খাটে ঘুমাতেন এবং তার বড় বোন একটি ছটো খাটে ঘুমাতেন । বড় বোন ফিরে দেখতে পেলেন , ওই ওই গভীর নিদ্রায় মেঝেতে পড়ে গেলেন । সংগে সংগে তিনি ওই ওইকে তার শোয়া ছটো খাটে তুলে নিলেন । তিনিও ভাবতে পারলেন না যে , সেজন্যেই ওই ওই মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলেন । সুই ওই ওই সেই দিনের কথা স্মরণ করে বলেছেন ,
তখন আকাশ খুবই উজ্জ্বল ছিল । আমি আপাকে জিজ্ঞেস করলাম , কি হয়েছে ? উত্তরে তিনি বললেন , আমিও জানি না । পরে আমরা বজ্রের মত বিকট শব্দ শুনলাম । যখন আমরা বুঝলাম , ভূমিকম্প হয়েছে , তখন আমাদের কাছের দেয়াল ভেংগে গেল । সেসময়ে মাটি নড়তে শুরু করল । তারপর আমরা দুজনই বাইরের মাটিতে পড়ে গেলাম ।
যখন ওই ওই মাটি থেকে আস্তে আস্তে ওঠলেন , তখন তিনি দেখতে পেলেন , তার বাড়ির চারতলার দালানের অর্ধেকাংশ ধ্বসে পড়েছে । তার সামনে ছিল স্তুপীকৃত পাথর ও ইট । তখন তার বড় বোন ইট-পাথরের মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন । ওই ওইকে দেখে তিনি কেঁদে কেঁদে চেচিয়ে ওঠলেন , বাবামা এখনো ভেতরে আছেন । তোমার মেজ বোনও আছে ভেতরে । সুই ওই ওই বলেছেন ,
আমরা দুজন মিলে আপনজনদের খোঁজার চেষ্টা করলাম । দালানের ওপর থেকে নিরন্তর পাথর আমাদের গায়ের ওপর পড়ছিল । তবে তখন আমরা সব বিপদ ভুলে গেলাম । শুধু চিন্তা করলাম যদি বাবামাকে পেতাম । বাইরে কোনো সাড়াশব্দ ছিল না । কেবল আমাদের দুজনের চিত্কার শোনা গেল ।
সেই সময়ে সুই ওই ওইয়ের বাড়ির কয়েকটি রাস্তার দূরত্বে বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ৬ মাসের নারী শিশু তাং ইয়ু সিন ঘুম থেকে জেগে উঁচু স্বরে কেঁদে ওঠল । ৫ বছর বয়সের চাং লি চি থান শান শহরের কেন্দ্রস্থলের একটি বিধ্বস্ত একতলার বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার সময় তার ডান পায়ে আঘাত পেয়েছিল । সে একদিকে কাঁদছিল , অন্যদিকে আতংকের সংগে বহুল পরিবর্তনশীল দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল ।
এই প্রলয়ংকর ভূমিকম্পে থাং শানের ৪ হাজারেরও বেশি ছেলেমেয়ে তাদের বাবামা হারিয়ে আশ্রয়হীন অনাথ হয়ে যায় ।
অল্প দিনের মধ্যেই এসব অনাথদের সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে । কেউ কেউ তাদের তাত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ওঠেছে । বয়োবৃদ্ধ নানী সুই ওই ওই ও তার বড় বোনকে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন । কোনো কোনো অনাথ থাং শানের অনাথদের জন্যে বিশেষভাবে নির্মিত স্কুল- ইয়ু হুং স্কুলে ভর্তি হল । তাং ইয়ু সিন ও চাং লি চিও সেই স্কুলে ভর্তি হল । সেখানে তারা বিনাখরচে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং চাকরীর ব্যাপারেও সুযোগ সুবিধা লাভ করেছেন ।
৩০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পর আজ এসব অনাথ কিভাবে দিন কাটাচ্ছেন ?
ফোং হোয়াং ইউয়ান হচ্ছে থাং শানের একটি সৌখিন আবাসিক এলাকা । সুই ওই ওইয়ের বাড়ি এই এলাকায় অবস্থিত । তিনি আমাদের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , এখন তিনি একটি বিজ্ঞাপন কোম্পানি পরিচালনা করছেন । তার স্বামী একটি ট্যাক্সি কোম্পানিতে কাজ করেন । তার মেয়ে একটি মাধ্যমিক স্কুলে পড়ে । তিনি বলেছেন ,
কিছু সময়ের জন্যে থাং শানের প্রায় সমস্ত বিজ্ঞাপন আমাদের কোম্পানির তৈরি । আমি ও আমার স্বামী উভয়ই ব্যস্ত । আমার মেয়ে সব বোঝে । সব কাজে সে স্বনির্ভর ।
তাং ইয়ু সিন আজ থাং শান পৌর প্রতিবন্ধী ফেডারেশনে কাজ করেন । প্রতিদিন তিনি প্রতিবন্ধীদের সেবার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন । এই কাজ করতে পেরে তিনি মহা খুশী । তিনি বলেছেন ,
যেসব প্রতিবন্ধীদের সংগে আমি মেলামেশা করি , সেসব প্রতিবন্ধী আমাদের থাং শানের ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতার সংগে সম্পর্কিত । সেই ভয়ংকর ভূমিকম্পের পর অনেক লোক বিকলাংগ হয়েছেন । যখন তারা শুনতে পেলেন , আমি ভূমিকম্পের অনাথ , তখন তারা সংগে সংগে আমার সংগে মিশে গেলেন । তাদের কোনো অসুবিধা হলে সবসময় আমার কাছে তা জানাতে দ্বিধা করতেন না ।
|