১লা জুলাই চীনের ছিংহাই-তিব্বত রেলপথ চালু হয়েছে। সুবিশাল ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে নির্মিত এই দীর্ঘ রেলপথের কল্যাণে তিব্বতী জনগণের যাতায়াত আর পরিবহনের অনেক সুবিধা হয়েছে এবং তিব্বতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তিব্বতী জনসাধারণের জন্যে এটি এক সোনার পথ।
মালভূমির এই রেলপথ নির্মাণের ফলে উত্তর তিব্বতের পশুপালক দোজিওয়াংজার পরিবারের সকলের জীবনযাত্রার পরিবর্তন হয়েছে। তাঁর ঘরে সাত জন লোক। তাঁরা ৪০টি তিব্বতী চমড়ি গরু এবং শতাধিক ছাগল ও ভেড়া পালন করেন। রেলপথ প্রকল্পটি নির্মাণের সময়ে দোজিওয়াংজা প্রকল্পটি নির্মাণস্থলের কাছে একটি তাঁবু খাটিয়ে শ্রমিকদের জন্য সিগারেট , মদ আর নুডলস ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য বিক্রীর ব্যবসা করেছেন। তার পরিবারের সদস্যরা রেলপথের নিরাপত্তা এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজে যোগ দিয়েছেন এবং তাতে অনেক উপার্জন করেছেন। গত বছর তার পরিবারের আয় প্রথমবারের মতো দশ হাজার ইউয়ান ছাড়িয়েছে। তিনি বলেছেন,
" আমি রেল গাড়ি ব্যবহার করে ব্যবসা চালাতে চাই। রেলগাড়িতে করে ছিংহাই প্রদেশের গোলমুদ শহরে যেতে চাই। আমাদের গ্রামের উত্পন্ন চমড়ী গরুর চামড়া, ভেড়া-ছাগলের চামড়া ও পশম সেখানে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করবো। তাতে যা আয় হয়, তা দিয়ে আবার সেখান থেকে নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য কিনে নিজের গ্রামে এনে গ্রামবাসীদের কাছে বিক্রী করবো।"
রেলপথ চালু হবার ফলে তিনি একজন পশুপালক থেকে ক্রমেই একজন ব্যবসায়ীতে পরিণত হচ্ছেন। তিব্বত অঞ্চলের আয়তন চীনের মোট আয়তনের আট ভাগের একভাগ। এর আগে চীনের অন্যান্য অঞ্চল আর তিব্বতের মধ্যে যাত্রী ও মাল পরিবহন বিমান আর ট্রাকের ওপর নির্ভর করতো। সেইভাবে পরিবহনের পরিমাণ রেলগাড়ির সঙ্গে তুলনা করা যায় না। রেলপথ চালু হবার ফলে পরিবহনের খরচ অনেক কমেছে এবং তা তিব্বতের লাগসই উন্নয়নকে নিশ্চিত করেছে । বিশেষ করে তিব্বতের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের সুবিধা হয়েছে এবং তিব্বতের খনিসম্পদের উন্নয়ন ও ব্যবহার ত্বরান্বিত হয়েছে।
পর্যটনশিল্প সম্পর্কে হংকংয়ের চায়না ইণ্টারন্যাশনাল ট্রাভেল এজেন্সির ডেপুটি ম্যানেজার মাদাম লিয়াং নুয়ান বলেছেন, "রেলগাড়িতে করে তিব্বত ভ্রমণের তিনটি সুবিধা আছে: এক, খরচ কম। বিমানে ভ্রমণের চেয়ে মাথাপিছু দু হাজার ইউয়ান কম খরচ পড়ে। দুই,বিমান থেকে মালভূমিতে হঠাত্ অবতরণ করলে মালভূমিজনিত অসুখ দেখা দিতে পারে, পক্ষান্তরে রেলগাড়িতে করে ধাপে ধাপে মালভূমিতে উঠলে এ-রকম অসুবিধা অনেক কম দেখা দেয়। তিন, ছিংহাই প্রদেশের সিনিং থেকে রেলগাড়িতে করে মালভূমি ,পাহাড়-পর্বত বেয়ে তিব্বতের লাসা পর্যন্ত ভ্রমণ করলে পথের দুপাশে অনেক মনোরম দৃশ্য চোখে পড়ে। বিমান ভ্রমণে তা দেখা যায় না।"
সত্যিই পৃথিবীর ছাদ বলে আখ্যায়িত ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে রেলগাড়িতে করে ভ্রমণ করলে ছিংহাই হ্রদ, হোহসিল এলাকার তিব্বতী এণ্টিলোপ , ইয়াংসি নদীর উত্স, টাংগুলা পর্বত, উত্তর তিব্বতের তৃণভূমি ইত্যাদি অভিনব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়। তা'ছাড়া ধর্মভক্ত তিব্বতীদের বিশেষ সংস্কৃতিও উপভোগ করার সুযোগ হয়। তিব্বত অঞ্চলের পর্যটন ব্যুরোর উপমহাপরিচালক জানুও মনে করেন, ১লা জুলাই রেলগাড়ি চালু হবার পর তিব্বত ভ্রমণে আসা পর্যটকদের সংখ্যা খুব দ্রুত বেড়ে যাবে। তিনি বলেছেন, " পয়লা জুলাই থেকে রোজ চারটি যাত্রীবাহী রেলগাড়ি আসা-যাওয়া করতে থাকবে। তাতে তিব্বত ভ্রমণকারীদের সংখ্যা চার হাজার জন বাড়বে। তা'ছাড়া বিমানেও এক হাজার যাত্রী আসেন। দিনে মোট ৫ হাজার লোক । অর্থাত্ তিব্বতে পর্যটকদের সংখ্যা দ্বিগুণ বাড়বে।"
এই রেলগাড়ি চালু হবার ফলে দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক আদানপ্রদানেরও সুবিধা হয়েছে। নেপালের ব্যবসায়ী তুলাদার লাসা শহরে সবচেয়ে নামকরা নেপালী দোকান পরিচালনা করছেন। এখন তিনি দেড় লক্ষ ইউয়ান পুঁজি বিনিয়োগ করে তাঁর দোকান নতুন করে সাজাচ্ছেন। তিনি তিব্বতে রেলপথ চালু হবার পর উন্নয়নের বিরাট সম্ভাবনা সম্পর্কে খুবই আশাবাদী। তিনি বলেছেন, " এই রেলপথ চালু হওয়াটা চীনের তিব্বত ও নেপালের জন্য এক সৌভাগ্যের ব্যাপার। এই রেলপথে চীনের প্রচুর পরিমাণ পণ্যদ্রব্য ছিংহাই থেকে লাসা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। পরিবহনের খরচ কমে যাবে। তখন আমরা ছিংহাই থেকে পণ্যদ্রব্য কিনে নেপালে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে পারবো এবং নেপাল থেকেও চীনে মাল পাঠাতে পারবো।"
বর্তমানে এই নেপালী ব্যবসায়ীর মতো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর অনেক ব্যবসায়ী এখান ব্যবসা চালাচ্ছেন। ভবিষ্যতে লাসা শহরের মধ্য দিয়েই চীন আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ব্যবসাবাণিজ্য চলতে থাকবে । এই ব্যাপারে লাসা হবে এক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য পরিবহন কেন্দ্র। তিব্বত অঞ্চলের সমাজ বিজ্ঞান একাডেমির অর্থনৈতিক নীতিকৌশল গবেষণা কেন্দ্রের উপমহাপরিচালক ওয়াং তায়ইউয়ান মন্তব্য করেছেন, ছিংহাই-তিব্বত রেলপথ চীন ও নেপাল তথা ভারত প্রভৃতি দক্ষিণ এশীয় দেশের মধ্যে সীমান্ত বাণিজ্যের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে। তিনি বলেছেন,
"ছিংহাই-তিব্বত রেলপথ চালু হবার পর চীনের অভ্যন্তর ভাগ থেকে লাসা পর্যন্ত পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। প্রচুর পরিমাণ পণ্যদ্রব্য লাসায় আসে এবং পরে সড়ক পথে অন্যান্য স্থানে পাঠানো যায়। আগের চেয়ে পরিবহনের অনেক সুবিধা হয়েছে। রপ্তানী পণ্যের পরিমাণ নিশ্চয়ই বিরাট মাত্রায় বাড়বে। কয়েক বছরের মধ্যেই তিব্বতের বৈদেশিক বাণিজ্যের বেশ দ্রুত উন্নয়ন হবে। ছিংহাই-তিব্বত রেলপথ চালু হবার পর ভবিষ্যতে তা আরও পশ্চিম দিকে সম্প্রসারিত করা যাবে, অর্থাত্ শিগাজে শহর পর্যন্ত এই রেলপথ প্রসারিত হবে। সেই শহর দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সীমান্ত বাণিজ্যের স্থলবন্দরগুলোর আরও কাছাকাছি হবে। এই রেলপথ চীন থেকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে পণ্য রপ্তানীর জন্য পরিবহনের স্থলপথে পরিণত হবে।"
|