চীনের হোনান প্রদেশের লুইয়েন জেলার চি-ইউয়ান উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে এক ছেলে ৫ বছর বয়স থেকেই তার বোড় বোনকে পিঠে বহন করে স্কুলে পড়তে পাঠায় । কারণ ছোটবেলায় বড়বোন পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয় । ১০ বছর ধরে ছোটো ভাই হান মিয়াও বড়বোনকে ইস্কুলে পড়তে পাঠাবার কর্তব্য কাঁধে বহন করে আসছে ।
হান চেন লুইয়েন জেলার চিয়াথান থানার ফাংচুয়াং গ্রামে জন্মগ্রহণ করে । চৌদ্দ মাস বয়সে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয় বলে বাসায় সে শুধু উবু হয়ে এগুতে পারত । তার চেয়ে দু'বছর ছোটো হান মিয়াও বোন হান চেনের সঙ্গে সম্পর্ক খুব ভাল । বোন বাইরে যেতে পারে না দেখে হান মিয়াও প্রায়ই বাসায় বোনের সঙ্গে খেলত ।সাত বছর বয়সে হানচেনের খালাতো বোন দেড়শ' ইউয়ান দিয়ে চেনচৌ থেকে তার জন্যে এক পুরানো হুইলচেয়ার কিনে দেয় । এর পর হুইলচেয়ার তার পা হয়ে দাঁড়ায় । তার সমবয়সী ছেলেমেয়েরা একের পর এক ব্যাগ নিয়ে স্কুলে পড়তে যায় দেখে হান চেন বারবার বাবামাকে স্কুলে যাওয়ার অনুরোধ জানায় । হানচেনের অনুরোধে বাবামার কষ্ট হয়। স্কুল তাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে । এক দিকে তাদের সংসারের জন্যে খাটতে হবে, অন্য দিকে হানচেনের অসুস্থ নানীকে দেখাশুনা করতে হবে ।তাই হানচেনকে তারা বেশি সময় দিতে পারেন না । বাবামার কষ্ট দেখে সেই সময় মাত্র ৫ বছর বয়সী হানমিয়াও এক আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিল যে, সে বোনকে স্কুলে পড়তে পাঠাবে ।
৫ বছর বয়সের হানমিয়াও হুইলচেয়ারের চেয়েও খাটো। স্কুল খোলার প্রথম দিন মা বোনকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দেন,তার পর ছোটো ভাই হানমিয়াও হুয়িলচেয়ার ঠেলে বোনকে স্কুলে পাঠায় এবং নিজের পিঠে বহন করে বোনকে ক্লাস-রুমে বসিয়ে দেয় । বলাবাহুল্য ,নিজের চেয়ে ভারি বোনকে পিঠে বহন করা ৫ বছর বয়সের ছোটো ছেলের পক্ষে কি কষ্ট তা ভাবতে কঠিন হবে না ।
এর পর বাতাস হোক,বা বৃষ্টি হোক প্রত্যেক দিন হানমিয়াও বোনকে স্কুলে পাঠায় । ভাই-বোন দুজনের কঠিন ও আনন্দের স্কুল-জীবন এমনভাবে চলতে থাকে এবং একদিনও থামেনি ।তাসত্ত্বেও বোন হান চেন মাঝেমাঝে মনে করতো যে,ভাই এত ছোটো বয়সে এত কষ্টে প্রত্যেক দিন আমাকে বাসা থেকে স্কুল আর স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়া-আসা করে,যদি আমি নিজের উপর নির্ভরশীল হতে পারি তাহলে কত ভাল হত । ভাবতে ভাবতে হঠাত একদিন দুজন অজানা লোক তাকে বলল,তাদের কারখানার তার মতো বিকলাঙ্গ মানুষ দরকার, কাজ আর প্রশিক্ষণ ছাড়া মাসে কারখানা তাকে ৪০০ রেনমিনপি দেবে । তাদের কথায় হানচেন প্রতারিত হয় এবং তারা তাকে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতে বাধ্য করে । হানচেনের অবস্থা জেনে তার বাবামা পুলিশের সাহায্যে তাকে উদ্ধার করেন ।
এই বিশেষ অভিজ্ঞতার পর ভাই-বোন দুজনের সম্পর্ক আরও নিবিড় হয় । তারা আগের চেয়ে আরও বেশি প্রচেষ্টা করে লেখাপড়া করতে শুরু করে ।ভাইর সাহায্যে ২০০২ সালের আগষ্ট মাসে হানচেন পরীক্ষা পাশ করে ভাই হান মিয়াওয়ের সঙ্গে চিয়াথান থানার এক নম্বর নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয় । বাড়ি থেকে মাধ্যমিক স্কুল অনেক দূরে । যাতে পড়াশুনা বন্ধ না হয় তার জন্যে ১১ বছর বয়সের হানমিয়াও প্রত্যেক দিন সাইকেল চালিয়ে বোনকে নিয়ে বাড়ি আর স্কুলের মধ্যে কয়েকবার আসা যাওয়া করে । ২০০৫ সালে ভাই-বোন দুজন শ্রেষ্ঠ ফলাফল দিয়ে জেলার উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয় । দারিদ্র্যের কারণে বাবামা ভাইবোনের মধ্যে শুধু একজনের স্কুল-ফি দিতে পারেন বলে দুজনের মধ্যে কেবল একজন উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে লেখাপড়া করতে পারবে । যাতে অন্যজন উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশুনা করতে পারে তার জন্যে ভাইবোন দুজনের মধ্যে প্রথমবার ভীষণ ঝগড়া হয় । ঠিক এই সময়ে লুইয়েন জেলার ইউয়ানচি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকরা হানচেনের সব কিছু এবং তাদের পরিবারের বাস্তব অবস্থা জেনে ফেলেছেন । উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল শুধু ভাইবোন দুজনের স্কুল-ফি মওকুফ করেনি বরং প্রতি মাসে তাদের কিছু আর্থিক সাহায্যও দেয় । তাদের ছাত্রাবাসে থাকার অসুবিধার কথা ভেবে স্কুলের নেতারা ভাইবোন দুজনকে বিশেষভাবে এক আলাদা রুম দিয়েছে।
ভাইবোন দুজনের ক্লাস-রুম তিন তলায় । ক্লাস নেয়ার সময়ে ভাই হানমিয়াও বোনকে পিঠে করে নিচ তলা থেকে শতাধিক সিঁড়ি ভেঙে ক্লাস-রুমে আসা-যাওয়া করে । দিনে বেশ কয়েকবার ওঠা-নামা করতে হয় । ২০০৫ সালের গ্রীষ্মকালের এক দিন অসাবধানে ভাইবোন দুজন এক সঙ্গে উপর থেকে নিচে পড়ে যায়। বোন হানচেন ভীষণ অনুতপ্ত হলেও ভাই হান মিয়াও কখনো স্কুলচ্যুত হওয়ার কথা ভাবেনি । সে বলল,পরে বোনের বিয়ে না হলেও সে চিরকালই তাকে পিঠে নিয়ে এখানে-সেখানে আসা-যাওয়া করবে। হানচেন-হানমিয়াও ভাই-বোন দুজনের কথা শীগ্গিরই সারা স্কুলে ছড়িয়ে পড়ে । তারা সহপাঠীদের কাছে সম্মানিত হয় । ভাই-বোনের জীবনযাপনের আস্থা আগের চাইতে অনেক বেড়েছে । তাদের লেখাপড়ার ফলফল সবসময়ই পুরোভাগের অধিকারী । গত স্কুল-টার্ম শেষের পরীক্ষায় ভাই হান মিয়াও প্রথম শ্রেণীর পুরস্কার লাভ করে এবং ৫০০ ইউয়ানের বৃত্তি পায় । বিগত ১০ বছরে ভাই হান মিয়াও বোন হানচেনকে পিঠে নিয়ে মোট ১০ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে । পিঠে তুলে ধরা আর পিঠ থেকে নামিয়ে দেয়া এই কায হান মিয়াও কমপক্ষে ৩০ হাজারবার করেছে ।
হান চেন বলেছে ,তার পক্ষে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূণর্ণ ব্যাপার হল
পড়াশুনা করা,পরে সুযোগ পেলে সে অবশ্যই এক নতুন হুইলচেয়ার পরিবর্তন করবে সে হুইলচেয়ার নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যাতে সে আর ভাই হান মিয়াওয়ের বোঝা না হয় । আর দু বছর পর ভাই-বোন দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার সম্মুখীন হবে । হান মিয়াও বলেছে, দুজন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে অব্যাহতভাবে বোনের সঙ্গে লেখাপড়া করবে । এর চেয়ে উত্তম উপায় তারা এখনো খুঁজে বের করেনি ।
|