চীনের সাংহাই মহানগরের দক্ষিণে রয়েছে ' চিনশান' এলাকা। চীনা ভাষায় 'চিনশান' শব্দটির অর্থ সোনার পাহাড়। তবে সাংহাই উপকণ্ঠের সব এলাকার মধ্যে চিনশান এলাকা তুলনামূলকভাবে গরীব। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিনশান এলাকার এই দরিদ্র অবস্থার ক্রমেই পরিবর্তন হয়েছে।
অতীতে চিনশান এলাকার অধিবাসীরা প্রধানত চাষাবাদ ইত্যাদি কৃষিকাজ করে যত্সামান্য আয় উপার্জন করতেন। সোং চিয়ে তাঁদের মধ্যে একজন । তিনি জানিয়েছেন, এই কয়েক বছরে তাদের জীবনযাত্রার উন্নতি হয়েছে। তিনি বলেছেন, "বসবাসের পরিবেশের কথা ধরা যাক, অতীতে অধিবাসীরা একতলা বাড়িতে থাকতেন, এখন বেশির ভাগ লোক বহুতলবিশিষ্ট বড় বড় বাড়িতে থাকেন। আগের চেয়ে যানবাহনের অনেক সুবিধা হয়েছে। সকল গ্রামের মধ্যে চালু রয়েছে সিমেণ্টের পাকা রাস্তা বা সড়ক। প্রতিটি গ্রামে স্থাপিত হয়েছে ক্লিনিক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শরীরচর্চা ও বিনোদনকেন্দ্র এবং বৃদ্ধবৃদ্ধাদের বিশেষ বিনোদনকেন্দ্র এবং পাঠাগার। গ্রামবাসীরা নিজের গ্রামেই এসব ব্যবস্থা উপভোগ করতে পারেন।"
চিনশান এলাকার আয়তন ৫৮০ বর্গকিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ৮ লাখ। চিনশান এলাকা ইতিমধ্যেই একটি কৃষিপ্রধান এলাকা থেকে একটি প্রাথমিকভাবে শিল্পায়ন ও শহরায়নের এলাকায় রূপান্তরিত হয়েছে। এলাকাটির সরকারী কর্মকর্তা লিউ চেংসিয়েন বলেছেন, " গত বছর চিনশান এলাকার শিল্প উত্পাদনের মোট মূল্য ৭৬০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। গত ৫ বছরে গড়পড়তা বার্ষিক বৃদ্ধিহার ৩৩.৮ শতাংশ। রসায়ন, ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি, ইলেক্ট্রনিক্স, বস্ত্র ও তৈরী পোষাক, গাড়ি ও যন্ত্রাংশ শিল্প হলো এই এলাকার অর্থনীতির প্রধান অবলম্বন। এই এলাকা শহরায়নের মাত্রা শতকরা ৫৫ ভাগেরও বেশি।"
১৯৭৯ সালে সাংহাই উপকণ্ঠের এই চিনশান এলাকায় 'সাংহাই পেট্রো-রাসায়নিক কোম্পানি" প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বড় প্রকল্প স্থাপনের সুবাদে এখানে আরও কয়েকটি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় সরকার উপলব্ধি করেছে যে, রাসায়নিক শিল্প এই এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই এলাকায় সূক্ষ্ম ও বহুমুখী প্রক্রিয়াকরণের রাসায়নিক শিল্প, জীববিদ্যাগত ওষুধ, বস্ত্রবয়ন-রাসায়নিক শিল্প ইত্যাদি উচ্চ মুনাফা অর্জনকারী ধারাবাহিক শিল্প গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী , ২০১০ সালে চিনশান এলাকায় ৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তন-বিশিষ্ট একটি রাসায়নিক শিল্প-এলাকা গড়ে তোলা হবে, ফলে বছরে তিন কোটি টন তেল শোধন করা যাবে এবং ৩০ লাখ টন ইথিলিন উত্পাদন করা যাবে। এর সঙ্গে সঙ্গে রাসায়নিক দ্রব্যের লোজিস্টিক্স ঘাঁটি নির্মাণ দ্রুততর করা হবে। বর্তমানে জার্মানির হেংকেল এবং যুক্তরাষ্ট্রের এপাচার কোম্পানি চিনশান এলাকায় পুঁজি বিনিয়োগ করে কারখানা স্থাপন করেছে।
তবে এই এলাকার উন্নয়ন শুধু যে রাসায়নিক শিল্পের ওপর নির্ভর করে, তা নয়। ২০০৩ সালে এখানে হাইটেক শিল্পপার্ক প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এখানে ইলেক্ট্রনিক্স তথ্য, জীববিদ্যাগত ওষুধপত্র, নতুন উপকরণ ইত্যাদি শিল্পের উন্নয়ন হবে।
চিনশান শিল্প এলাকার পরিচালনা কমিটির দায়িত্বশীল ব্যক্তি সুন ইংলিয়াং বলেছেন, " আধুনিকায়ন , ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য, এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের তত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের শিল্পপার্কের গঠন পরিকল্পনা তৈরী হয়েছে। আমাদের গোটা শিল্পপার্কে থাকবে ৮টি আবাসিক কেন্দ্র, প্রত্যেক কেন্দ্রের আয়তন ৫ বর্গকিলোমিটার। প্রত্যেক কেন্দ্রে আছে বাসস্থান, বিনোদন ব্যবস্থা, ডাইনিং হল এবং রেস্তোরাঁ এবং দোকানপাট। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এইসব কেন্দ্রে বসবাস করতে পারবেন। তাতে শক্তিসম্পদ ইত্যাদি সাশ্রয় করা যায় এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উত্পাদন খরচ কমানো যায়। এটাই এই শিল্পপার্ক প্রকল্পের সুবিধা।"
চিনশান শিল্প-এলাকা প্রতিষ্ঠার প্রকল্পে স্থানীয় সরকার পর্যায়ক্রমে ১৩ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করে যাতায়াত,পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, পানি সরবরাহ ও শক্তিসম্পদ ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। এর সুবাদে এই শিল্পপার্কে প্রবেশকারী কোম্পানি সুবিধাজনক পরিসেবা পেয়েছে । এই শিল্পপার্কের আকর্ষণ বেড়েছে। এই শিল্পপার্ক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যেই শতকরা ২০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, এখানে দ্রুত শিল্প উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ দূষণ এড়ানো হয়েছে। স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তা লিউ চেংসিয়েন বলেছেন, " টেকসই উন্নয়ন সুনিশ্চিত করার জন্য আমাদের শিল্পপার্কে পরিবেশ সংরক্ষণের তিন-সালা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় । পরিবেশ ও বায়ুমণ্ডলের বায়ুর গুণগত মান বা পরিষ্কার হবার মাত্রা পরীক্ষা করার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ৩৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কয়লার বয়লারের পরিবর্তে পরিষ্কার শক্তিসম্পদ ব্যবহার করার ব্যবস্থা হয়েছে। বৃক্ষ রোপণ করে বনানী সৃষ্টি করা হয়েছে, বিশেষ করে পানিসম্পদ সংরক্ষণের বনাঞ্চল এবং অর্থকরী বনাঞ্চল সৃষ্টি করা হয়েছে। ৭টি প্রধান নদীর সংস্কার করা হয়েছে। ফলে চিনশান এলাকার আকাশ আরও বেশি নীল, মাঠ আরও সবুজ এবং নদনদীর পানি আরও বেশি পরিষ্কার হয়েছে।"
এসব ছাড়াও চিনশান এলাকা একটি উপকূলীয় এলাকা বলে নিজের এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে পর্যটন শিল্প উন্নয়নের প্রয়াস চালানো হচ্ছে। সাগর তীরে বিশেষ ক্রীড়া ও বিনোদন ব্যবস্থা, সাগরের দৃশ্য উপভোগ করার ভ্রমণ এবং প্রদর্শনী ও লজিস্টিক্স ইত্যাদি ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন সাধিত হয়। ২০০৪ সাল থেকে পর পর দু বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে বিশ্ব সৈকত( বীচ) ভলিবল ভ্রাম্যমান প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়েছে। পরিসংখ্যা থেকে জানা গেছে , গত বছর চিনশান এলাকায় পর্যটন খাত থেকে ৩ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি আয় অর্জিত হয়েছে। পর্যটকদের মোট সংখ্যা ছিল ৪.৫ লাখেরও বেশি। দৃশ্য উপভোগ এবং কেনাকাটার জন্য ১.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এক পর্যটন করিডর নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে উপকূলীয় নৌবিহার ক্লাব স্থাপিত হবে।
|