গত বছরের শুরু থেকে চীনা কোম্পানি বিদেশে একের পর এক বিদেশী কোম্পানি কিনেছে আত্মিকরণের মাধ্যমে। যেমন চীনের লেনোভো সাফল্যের সঙ্গে 'আই বি এম'-এর ব্যক্তিগত কম্পিউটার ব্যবসা কিনে ফেলেছে । চীনা কোম্পানি কেন বিদেশে গিয়ে পুঁজি বিনিয়োগ করছে? বিদেশে বাজারে প্রবেশের পথে চীনা কোম্পানি কি-রকম অসুবিধার মুখোমুখী হচ্ছে?
গত বছরের মে মাসে চীনের বৃহত্তম কম্পিউটার উত্পাদন কোম্পানি-- লেনোভো গোষ্ঠী১২৫কোটি মার্কিন ডলার দিয়ে 'আই বি এম'-এর ব্যক্তিগত কম্পিউটার ব্যবসা কিনে ফেলেছে । এর পর লোনোভো গোষ্ঠী বছরে ১৩ লক্ষ মার্কিন ডলারের পণ্য বিক্রী করেছে এবং সেই সুবাদে বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম কম্পিউটার উত্পাদনকারী কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে লেনোভো গোষ্ঠীর ভাইস প্রেসিডেণ্ট লিউ সিয়াওলিন বলেছেন, "লেনোভো গোষ্ঠী চীনের বাজার সম্বন্ধেখুব ভাল জানে এবং চীনে তার মার্কা খুবই বিখ্যাত, চীনের বাজারের এক বিরাট অংশ তার হাতে। 'আই বি এম' চীনের বাজারের এক খুব ছোট অংশই শুধু দখল করেছে। চীনা বাজারে তার বিক্রয় ব্যবস্থাও আমাদের চেয়ে দুর্বল , কিন্তু তারা বিদেশের বাজারে আমাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। লেনোভোর ডেস্কটপ পিসি খুব ভাল বিক্রী হয়, পক্ষান্তরে 'আই বি এম'-এর বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য নোটবুক কম্পিউটার ব্যবসার প্রাধান্য আছে। এ সব দিক দিয়ে দু পক্ষ পরস্পরের পরিপূরক, দু'য়ের মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাবনা খুব কম।"
চীনের তেল কোম্পানি সাফল্যের সঙ্গে কাজাখস্তানের পি কে তেল কোম্পানি কিনে ফেলেছে, চীনের নানচিং গাড়ি গোষ্ঠী ব্রিটেনের বিখ্যাত রোভার গাড়ি কোম্পানি কিনে ফেলেছে। তাতে প্রতীয়মান হয়েছে যে, চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো খুবই শক্তিশালী। তারা ক্রমেই বিদেশী কোম্পানি কিনে নেয়ার পথে চলেছে।
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী মন্ত্রী ছেন চিয়েন মন্তব্য করেছেন বিদেশে চীনা কোম্পানির পুঁজি বিনিয়োগের প্রধান পদ্ধতি হলো আত্মিকরণ। তিনি বলেছেন, " ২০০৫ সালে বিদেশে চীন ৬৯০ কোটি মার্কিন ডলার পুঁজি সরাসরি বিনিয়োগ করেছে। তা আগের বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশী । তার মধ্যে কিনে ফেলা বা আত্মিকরণের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ছিল ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার। বিদেশে চীনের এই বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ছে , তা দেশের অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেছে এবং বিশ্বের শিল্প কাঠামোর পুনর্বিন্যাস ও যুক্তিযুক্ত বণ্টনের ব্যাপারে সক্রিয় অবদান রেখেছে।"
চীনের কতকগুলো নতুন ধাঁচের কোম্পানির গবেষণা ও উদ্ভাবনের বেশ কিছু সামর্থ্য আছে। যেমন জিটিই করপোরেশন, হুয়াওয়েই , হাইয়ের, হাইসেন্স, লেনোভো ইত্যাদি কোম্পানি বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ ও সহযোগিতার পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক কোম্পানি হিসেবে সুপরিণত হবার পথে এগিয়ে চলেছে। ঘরোয়া বৈদ্যুতিক সামগ্রী, বস্ত্র, পোষাক, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি শিল্পে চীনা কোম্পানির সুস্পষ্ট প্রাধান্য আছে । এই সব ক্ষেত্রে চীনা কোম্পানি বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ করে শাখা কোম্পানি বা কারখানা স্থাপন করেছে।
'ইউ এন সি টি এ ডি'র বিনিয়োগ বিষয়ক মহাপরিচালক খালিল হামদানি বলেছেন, " ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিদেশে চীনা কোম্পানিগুলোর অন্তত ২৭৭ বার আত্মিকরণ প্রকল্প চালু হয়েছে । এশিয়ায় চীন প্রথম স্থান অধিকার করেছে। গত বছর উন্নত দেশগুলোতে চীনের আত্মিকরণ প্রয়াস দ্রুত বেড়েছে । দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিতে বিদেশে চীনের পুঁজি বিনিয়োগের প্রবনতা হলো বিখ্যাত মার্কা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং উত্পাদন পণ্য বা সরঞ্জাম , এমন-কি উন্নত দেশগুলোর বাজার কিনে ফেলা।"
এই পথে অসুবিধাও হয়েছে। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে প্রচণ্ড রাজনৈতিক চাপ থাকার ফলে চীনের তেল কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনোকাল তেল কোম্পানি কিনে ফেলার প্রয়াস ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে চীনের লেনোভো কোম্পানির ব্যবসায়ও অসুবিধা দেখা দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর লেনোভো কোম্পানির কাছে এক কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের কম্পিউটার কেনার অর্ডার দিয়েছে । কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো লোক তাতে খুব বাধা দিয়েছেন । এই চাপে পড়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এই অর্ডারের আংশিক পরিবর্তন করেছে।
লেনোভোর ভাইস প্রেসিডেণ্ট লিউ সিয়াওলিন বলেছেন,
" জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রচুর সংখ্যক কোম্পানি বিদেশে গেছে । যদি চীনা কোম্পানিও তাদের মতো করতে এবং বিদেশে চীনের অর্থনীতির শক্তি দেখাতে পারে,যাতে বিদেশিরা উপলব্ধি করতে পারেন যে, চীনা কোম্পানিগুলো বিদেশেও পুরোপুরি বাজার নীতি অনুসরণ করে উন্মুক্ত আর ন্যায়সঙ্গতভাবে কাজ করে, তা'হলে বিদেশী খদ্দেররা লেনোভো-সহ চীনা কোম্পানিগুলোর প্রতি অনুকূল মনোভাব দেখাবে এবং সন্দেহ বা আপত্তি করবেন না।"
বিশেষজ্ঞদের মতে বিদেশে আত্মিকরণের ব্যাপারে চীনা কোম্পানিগুলো এখনও খুব নগণ্য ভূমিকা পালন করছে, মানে পিছিয়ে আছে। মোট জি ডি পি বা বাণিজ্যের পরিমাণের দিক থেকে হিসেব করলে আত্মিকরণের ক্ষেত্রে ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান মানে উপনীত হতে চীনকে এখন থেকে অন্তত আরও দশ গুণ সাফল্য অর্জন করতে হবে ।
চীনের সহকারী বাণিজ্য মন্ত্রী ছেন চিয়েন বলেছেন, বিদেশে চীনের পুঁজিবিনিয়োগ যদিও দ্রুত এবং বিরাট মাত্রায় বেড়ে চলেছে, তবে তার পরিমাণ চীনে বিদেশী পুঁজিবিনিয়োগের পরিমাণের চেয়ে অনেক কম। চীনা কোম্পানিগুলোকে বিদেশে ব্যবসা চালানোর দক্ষতা উন্নততর করতে হবে ।
|